Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও আগামীর পথচলা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাঁক পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। সে পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে নিয়ে একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত চলা পাকিস্তানি নব্য-উপনিবেশী শাসনের ভিত গড়ে দেওয়া পরিত্যাজ্য এবং প্রত্যাখ্যাত সব মতাদর্শ, নীতি-চিন্তা এবং চর্চাগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে পরাজিত পক্ষটির পুনঃ অধিষ্ঠান। সেই লক্ষ্য মোটামুটি সফলও হয়েছিল। কারণ, পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িকতা, উদারনীতি এবং সংস্কৃতিবিরোধিতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি—যাতে ধর্মের আদর্শ ও সৌন্দর্যগুলো অনুপস্থিত এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে সেনাশাসনের প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে যে সংবিধানটি রচিত হয়েছিল, যার মূলনীতিগুলো ছিল পাকিস্তানি মতাদর্শের বিপরীত, সেগুলো কাটাছেঁড়া করে সেসব নীতি বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু একটি শিক্ষানীতি তৈরির উদ্যোগ নেন, যা হতে পারত একটি স্বাধীন জাতির মানসগঠনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল, কিন্তু সেই নীতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ হলেও সেটিকে ১৫ আগস্টের পর প্রত্যাখ্যান করা হলো। ফলে রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি—কোনো ক্ষেত্রেই একাত্তরের উদ্দীপনাময়ী চিন্তা ও আদর্শগুলোর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। দুঃখজনকভাবে, দেড়-দুই দশকের মতো সময় ধরে এই অবস্থা চলতে থাকায় আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সেই শক্তির সঞ্চার আর হতে পারেনি, যা এই জাতির আগামীর পথচলাকে সময়ের সব দাবি মিটিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারত।
ইতিহাসের এই বাঁক পেছন দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে অনেক মহলের বা পক্ষের বিনিয়োগ ছিল। তার মধ্যে ছিল একাত্তরে যারা পরাজিত হয়েছিল, তাদের এদেশীয় প্রতিনিধিরা; পৃথিবীর কোথাও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দেখতে না চাওয়া পুঁজিবাদী শক্তি, যারা ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ, অবদমন এবং সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চায়, তারা এবং পশ্চিমের সামরিক-শিল্পপতি বলয়ের পক্ষে সক্রিয় গোষ্ঠীগুলো। এই পক্ষগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের চোখে সবচেয়ে বড় বিপদ। ফলে তাঁকে বিদায় করে দেওয়াটা ছিল তাদের সম্মিলিত প্রয়াস।
এ জন্য ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার এবং নিতান্ত অসময়ে তাঁর চলে যাওয়ার জন্য শোক প্রকাশের পাশাপাশি কেন এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সমাজে যে সহিংসতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, নীতিহীনতা এবং উগ্রবাদের চর্চা হচ্ছে, শিক্ষা যে গতি হারাচ্ছে, সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছে—এসবের মূল কারণগুলোই হয়তো তাতে পাওয়া যাবে।

২.
একটি জাতির মানসগঠনের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শিক্ষা বলতে পরীক্ষাকেন্দ্রিক, মুখস্থভিত্তিক এবং উচ্চতর পর্যায়ে চাকরিবাজারে ঢোকার একটা যেনতেন উপায় করে দেয় যে শিক্ষা, তা নয়; বরং সেই শিক্ষা, যা একজন শিক্ষার্থীর সব সক্ষমতাকে সক্রিয় করে, তার বিষয় ও জীবনদক্ষতাসহ প্রয়োজনীয় সব কুশলতা নিশ্চিত করে তাকে আলোকপ্রাপ্ত একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করে। এই শিক্ষা জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে সংবেদী দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ ঘটায়, শিক্ষার্থীকে উন্নত মানুষে রূপান্তরিত করে। আর সংস্কৃতি অর্থে নৈতিকতা ও সৌন্দর্যবোধের সমন্বয়ে সৃষ্ট সৃজনশীলতার চর্চা, যা মানুষকে রুচিমান এবং শুদ্ধাচারী করে, অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখায়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই আদর্শচর্চার পেছনে রাষ্ট্র থেকে পরিবার—প্রত্যেক পক্ষে সক্রিয়তা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় সব সমর্থন পাওয়া গেলেও এবং একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়ার পরও এ থেকে ফল লাভে কিছুদিন সময় লাগে।
একাত্তরের পর জাতি উন্মুখ ছিল একটা পরিবর্তনের জন্য, যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। যদি কুদরাত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো সেই সময় থেকেই নেওয়া যেত, যেগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রতিবছর দেশের জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ, তাহলে আজ আমরা সেই বাংলাদেশ পেতাম, যার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। বরং ইংরেজি মাধ্যমের আবির্ভাব এবং শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ফলে তিন ধারায় বিভক্ত এক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়, যা আগামীর পথচলার জন্য সহায়ক হওয়া তো দূরের কথা, বতর্মানকেও তা গতিশীল করতে অপারগ।
সংস্কৃতি বলতে আমরা যে শিল্প-সাহিত্য এবং ঐতিহ্যচর্চা বুঝি, তা–ও তো এখন বিপন্ন ও বাধাগ্রস্ত। সংস্কৃতির বিস্তৃত সংজ্ঞাকে বিবেচনায় আনলে সেখানেও দেখা যাচ্ছে বিপর্যয়। এর ফলে আমাদের মানসগঠনে বিরাট প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার অভাবে যা হয়, আমরা এখন তা-ই দেখছি। আমার ধারণা, বাংলাদেশে এখন আমরা উগ্রতা এবং সহিংসতার একটা যুগই তৈরি করে ফেলেছি। এখন সহিংসতা সর্বত্র, উগ্রতা যত্রতত্র। যখন ধর্মের নামে উগ্রতা চলে, তখন এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল।

বঙ্গবন্ধু আমাদের এক নব্য-উপনিবেশী শাসন থেকে মুক্ত করেছিলেন। যাঁরা এমনকি স্কুলের ছাত্র হিসেবেও ১৯৫০ ও ’৬০-এর দশক দেখেছেন, তাঁরা জানেন বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি পাকিস্তানিদের কী আচরণ ছিল! মুক্তিযুদ্ধ সেই বৈরিতার অবসান ঘটিয়েছিল। একাত্তরের পর আমাদের প্রত্যাশা তাই ছিল আকাশছোঁয়া, কিন্তু বাস্তব ছিল ভয়াবহ, সর্বত্র ছিল ধ্বংসযজ্ঞ। এই বিধ্বস্ত একটি দেশকে টেনে তোলা ছিল প্রায় অসম্ভব এক কাজ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই কাজটি শুরু করেছিলেন। চুয়াত্তরে উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিল। এর পেছনের বড় কারণ ছিল ভূরাজনীতি—কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ বাংলাদেশকে খাদ্যসহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে এই দুর্ভিক্ষাবস্থার পেছনে আমাদেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। একাত্তরে যখন শহরের মানুষ সুরক্ষার জন্য গ্রামে ছুটে গেছেন, গ্রামের মানুষ তাঁদের জন্য ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। আর চুয়াত্তরে উত্তরের গ্রামের ক্ষুধার্ত মানুষ যখন ঢাকায় এসে একটু সহায়তা চেয়েছেন, ঢাকার মানুষ তাঁদের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। অনেকে দেখি চুয়াত্তরের মানবসৃষ্ট প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থার জন্য নিজেদের অভিযুক্ত করেন না। সব অভিযোগ তোলা থাকে সরকারের বিরুদ্ধে, অথচ বাংলাদেশের সম্পদ বলতে তখন কিছুই ছিল না। অভিযোগ তাই প্রথমেই তোলা উচিত আমাদের নিজেদের পাশাপাশি পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে, যারা দেশটাকে নিঃস্ব করেছিল। অভিযোগ তোলা উচিত ভূরাজনীতির নিয়ন্তাদের বিরুদ্ধে।
এ অবস্থার অবসান হতো যদি আমরা প্রকৃত শিক্ষা পেতাম এবং একই সঙ্গে যদি সেই সংস্কৃতির চর্চা হতো, যাতে চিত্তের মুক্তি ঘটে এবং নান্দনিক মানুষ তৈরি হয়।

৩.
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল শুধু পাকিস্তান পন্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য নয়, বাংলাদেশের সম্মুখযাত্রার পথ রুদ্ধ করার জন্যও। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যাচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা হয়েছে, শিক্ষা গতিহীন হয়েছে, সংস্কৃতিকে কক্ষচ্যুত করা হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে বর্তমানেও। কারণ, গত কয়েক দশকে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মূল্যবোধ ও উদারচিন্তার ক্ষয় হয়েছে, যার ফলে উগ্রতা ও সহিংসতার এত বিস্তার ঘটেছে। এর অভিঘাতে মানুষের জীবনাচরণ থেকে রাজনীতি পর্যন্ত সবখানে স্বার্থচিন্তাই হয়ে উঠেছে প্রধান। এভাবে চললে আগামীর পথে আমাদের পা ফেলা কঠিন হবে।
এ জন্য এখনই আমাদের নজর দিতে হবে শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে। শিক্ষায় বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এর মধ্যে ঘটেছে, তবে তা আরও ব্যাপক হতে হবে। যদি আমরা শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এগোই; যদি সারা দেশে ঐতিহ্যবাহী, মূল্যবোধ ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়, তাহলে এক প্রজন্মে আমরা তার সুফল পাব। তখন রাজনীতি বদলাবে। বাংলাদেশও বদলে যাবে। যদি তা সম্ভব করতে পারি, তা হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার প্রদর্শন।

0Shares