Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে অটোরিকশায় তুলে দেওয়ার ২৫মিনিট পরই শুনি আমার স্ত্রী আর নেই’

‘প্রথম সন্তান হবে। ঘরে ধাত্রী এনে রাখা হয়। ঘর ভর্তি মানুষ। সবার চোখে-মুখে আনন্দ। প্রসবযন্ত্রণা উঠলেও বাচ্চা প্রসব না হওয়ায় একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা এনে ধাত্রী, বাবা-মা, শাশুড়িকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে তুলে দিই। ২৫মিনিট পরে শুনি একটি লরির সঙ্গে সংঘর্ষে আমার স্ত্রী ও শাশুড়ির লাশ মহাসড়কে পড়ে আছে। যেন আমার জীবনটিই শেষ হয়ে গেল।’

বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে তিনটায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার বানিয়ারছড়া এলাকায় লরি ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত জেসমিন আকতারের স্বামী মামুনুর রশীদ এভাবেই তাঁর আনন্দ বিষাদে রূপ নেওয়ার বর্ণনা দেন। এদুর্ঘটনায় নিহত হন তাঁর শাশুড়ি রোকেয়া বেগমও। মামুনুরের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ভান্ডারির ডেবা এলাকায়। তিনি পেশায় ট্রাক চালক। গত বছরের নভেম্বরে মামুনুর রশীদের সঙ্গে বিয়ে হয় পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের লঞ্চঘাট এলাকার আব্দুস সালামের মেয়ে জেসমিন আকতারের।

শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ভান্ডারির ডেবা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশ ধরে পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ি ছড়া। ছড়ার ওপর সাঁকো পার হয়ে একটি টিনশেড মাটির দেওয়াল ঘর। এই ঘরে থাকতেন জেসমিন আকতার। ঘরের সবই তরে তরে সাজানো। সবই আছে, নেই শুধু গত ১০ মাস আগে হাতে মেহেদি রাঙিয়ে বধূ সেজে আসা জেসমিন আকতার। পুরো বাড়িতে শুনসান নিরবতা। মামুনুরের কয়েকজন বন্ধু বিকেল পাঁচটার দিকে তাকে ভান্ডারির ডেবা গ্রামের একটি দোকানে নিয়ে গেছেন। গ্রামের চায়ের দাকোনে বসে কথা হয় মামুনুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুজনে কত স্বপ্ন দেখেছি। ছেলে হলে আমি জিতব আর মেয়ে হলে সে। দুজনের মধ্যে এমন কত খুনসুটি হতো। আজ সবই মাটি হয়ে গেল। আমার স্বপ্নের তাসের ঘর ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।’ মামুনুর বলেন, ‘সে নিশ্চয় জানতো আমাকে ছেড়ে সে পরপারে পাড়ি জমাবে। নইলে এতো অল্প সময়ে মানুষ কিভাবে এতো ভালোবাসতে পারে। দুজনের মধ্যে কখনও এক মিনিটের জন্যই মনোমালিন্য হয় নি। ঘরের অনেকে সেটি নিয়ে হিংসে করতো।’ মামুনুর বলেন, ‘যখন তাকে অটোরিকশায় তুলে দিই, তখনও সে বলছিল আমি যেন তাঁর সাথে যাই। বাচ্চার প্রথম মুখ যেন তাঁর আগে আমি দেখি। কিন্তু বাচ্চার মুখ তো দেখিইনি, দেখেছি আমার ভালোবাসার মানুষের মরা মুখ। এমন জানলে তাঁর সঙ্গে আমিও যেতাম।’

কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে মামুনুরের। তিনি বলেন, ‘ভাই, কথা বলতে পারছি না। আমার সুখের বাগান শেষ হয়ে গেছে। সে একবার কক্সবাজার যেতে চেয়েছিল। কথা দিয়েছিলাম, বাচ্চা হলে তিনজনে মিলে কক্সবাজার বেড়াতে যাবো। আল্লাহ আমার বউয়ের সেই আশা অপূর্ণ রেখেই নিয়ে গেল।’

‘আমি আন্ত:জেলায় ট্রাক চালাই। সব সময় সে আশঙ্কা করে বলতো আমি যেন সাবধানে গাড়ি চালাই, যেন দুর্ঘটনায় পতিত না হই। ঘর থেকে বের হলেই একাধিকবার ফোনে খবর নিতো আমি কি করি, সাবধানে গাড়ি চালাই কিনা-এসবের। কিন্তু যে দুর্ঘটনাকে সে ভয় পেত, সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তাঁর।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামুনুর। ‘আমি বাইরে থাকি বা সে একা থাকুক কখনও চাইতো না। কিন্তু গতকাল রাত পৌনে ১১টায় আমি নিজ হাতে মাটির ঘরে তাকে একা রেখে এসেছি। বড্ড নিষ্ঠুর কাজই আমি করে এসেছি।’- বলেন মামুনুর।

মামুনুরের বাবা দুদুমিয়া ও মা রাবেয়া বেগমও একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। দুদুমিয়ার নাক দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। মায়ের অবস্থা এখন একটু ভালো। মামুনুর রশিদ বলেন, জেসমিন তো নাই হয়ে গেলো। এখন বাবাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তাঁর অবস্থা ভালো না। আমরা গরীব মানুষ। ভালো চিকিৎসাও করাতে পারছি না।’

0Shares