সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া শিশু কিছু বুঝে না জানে না চলাচল করতে পারে না। পৃথিবীতে প্রাণীকূলের মধ্যে একমাত্র মানব শিশু ইতর প্রাণী হয়ে ভুমিষ্ঠ হয়। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব হচ্ছে মানব জাতি। মহান সৃষ্টিকর্তা এই মানব জাতির মধ্যে এমন এক প্রতিভা লুকায়িত রেখেছেন, যার ধীরে ধীরে বিকাশের মধ্য দিয়ে মানব সন্তান হয়ে উঠে সৃষ্ঠির সেরা জীব। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে অনুকরণ করে অবচেতনভাবে শিশুর মেধার বিকাশ শুরু হয়। তাছাড়া শিশু প্রকৃতি ও পরিবেশকে অনুকরণ করে হাঁটতে শিখে, কথা বলতে শিখে,একটু একটু করে সব বুঝতে শিখে-এই সব শিক্ষা শিশু আনন্দঘন পরিবেশে, আদর-স্নেহ অবচেতনভাবে অর্জন করে। তাই সেই মেধার বিকাশ আজীবন স্থায়ী হয়ে থাকে। মায়ের মুখে শেখা ভাষা শিশু স্বাধীনভাবে শিখে। এই শিক্ষা স্থায়ী। আমাদের সবার উচিত মানসিক চাপ ছাড়া শিশুকে আনন্দঘন পরিবেশে রেখে, হেসে-খেলে বড় করা যেন শিশুর মেধার বিকাশ হয়। আমাদের শিশু ভীষণ কৌতুহলী, কর্মঠ ও প্রতিভাসম্পন্ন। তাই শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য প্রয়োজন আনন্দঘন পরিবেশে কোনো ধরণের মানসিক চাপ ছাড়া শিক্ষাগ্রহণ। উপযুক্ত পরিবেশ ও সহযোগিতা পেলে শিশুর পরিপূর্ণ মেধা বিকাশে আসবে সক্ষমতা। তারা হয়ে উঠবে আত্মবিশ্বাসী।
শিক্ষকতার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলদ্ধি হল শিশুর বুদ্ধিবৃত্তীয়, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শৈশবের শুরুর পর্যায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় শিশু মনোযোগ দিয়ে শুনে, কথা বলে, কথা ও ইঙ্গিতে সাড়া দেয়। শব্দের অনুকরণ করে, বড়দের অনুকরণ করে, বন্ধুত্ব গড়ে তুলে। সমস্যার সমাধান করে ও খেলাধুলা করে।
শিশুর শৈশবের এই প্রারম্ভিক পর্যায়ে উৎসাহ জোগানো বিচিত্র এই সব অভিজ্ঞতা শিশুর সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। সেই গুলোকে ঘিরে তার মেধা বিকশিত হয়।তারা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। প্রতিভাবান শিশুরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ চায়। তারা নিজের গতিতে শিখতে চায়। যে শিশু শৈশব থেকে কথায় কথায় যত বেশি প্রশ্ন করে তার জানার আগ্রহ তত বেশি । ফলে তার মেধার বিকাশ দ্রুত হয়।
যদি কেউ প্রশ্ন করেন, শিশুকে চাপের মধ্যে রাখলে শিশুর মেধা বিকাশ ফলপ্রসু হবে কিনা? একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও শিশু মনের উপলদ্ধি থেকে বলব, আনন্দ ঘন পরিবেশে শিশু যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রসু। আনন্দঘন পরিবেশে শিশি স্বতঃস্ফূর্তমনে শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষক কিংবা অভিভাবক সকলের প্রয়োজন শিশুকে কোনো ধরণের ভয়ভীতি না দেখিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে শেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছেন, ”শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। শিশুকে চাপ নয় ,স্বাধীনতা দিন। ” আপনারা কেউ যদি প্রশ্ন করেন, শিশুর প্রতিভা বিকাশে ভূল বা ব্যর্থতা কী অন্তরায়? আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলব ভুল বা ব্যর্থতা প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হতে পারে না। আসলে শিশুর ভুল বা ব্যর্থতা ভীতিকর কিছু নয়। তারা যেন ভুল করাকে ভয় না পায়। ভুলগুলোকে তার শিক্ষার অংশ হিসেবে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকের দেখা উচিত।
বরং ভুল থেকে শিশু শিক্ষা গ্রহণ করে। শিশুকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন।সব শিক্ষার মূলে রয়েছে জানার আগ্রহ বা জিজ্ঞাসা। শিশু যতই কী কীভাবে কেন প্রশ্ন তুলবে, তার সাফল্যের সম্ভবনা ততই বাড়বে। তার মেধার বিকাশ দ্রুত হবে। পরিবার-পরিজন কিংবা শিক্ষকের কাছে এমনভাবে প্রশ্ন করে শিশুরা। আমরা বড়রা অনেক সময় অধৈর্য্য হয়ে পড়ি। আমাদের অধৈর্য্য না হয়ে তাদের প্রশ্ন শুনতে হবে এবং তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে হবে। অনেক সময় শিশুরা এমন কিছু প্রশ্ন করে যেগুলোর উত্তর আমাদের জানা থাকে না। তখন শিক্ষক কিংবা অভিভাবক অনেকে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু আমাদের উচিত তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে সঠিক উত্তর জেনে দেওয়া। কারণ আমরা যদি ভুল উত্তর শিখায়, শিশু ভুলটায় শিখবে। এই প্রশ্ন করার মাধ্যমে শিশুর মেধার বিকাশ হয়। এই শেখার আগ্রহ পরবর্তীতে তাকে সাফল্যের দরজায় নিয়ে যাবে। শিশুর ভুল বা ব্যর্থতাকে সফলতার সোপান হিসেবে ধরে সামনে অগ্রসর হওয়া উচিত। এই ব্যর্থতা অনেক সময় শিশুর মনে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।
শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশের মূল কথা হল প্রতিটি শিশুর ব্যক্তিত্বের গঠন হয়ে যায় তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। বাকি জীবনটা তার বিকাশের কাল। সুতরাং শৈশবের শুরুতে অস্বাভাবিক ক্ষমতা রাখলে বুঝবেন আপনার বাচ্চা হয়ত প্রতিভাধর। তবে এই সময় বাচ্চাদের কোনো লেভেল বা তকমা লাগানো উচিত নয়। তখন হয়ত বাচ্চা অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। শিশুকে স্বাধীনতা দিন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিন। পরিশেষে বলতে চাই, শিশুবান্ধব পরিবেশে শিক্ষার ব্যাপারে পিতা-মাতা, ভাইবোন ও অন্যান্য বড় সদস্যদের ভূমিকা থাকতে হবে।পরিবারের সদস্যদের সবসময় সচেতন ও সর্তক থাকতে হবে। শিশুর পরিবারে থাকতে হবে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ এবং বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।