👤 সমুদ্র সংবাদ ডেস্ক
প্রাণিজগতে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণার নিত্যনতুন ফলাফল রীতিমতো চমকে দেয় আমাদের। জনপ্রিয় ও সুস্বাদু কোরাল মাছের একটি বৈশিষ্ট্যও মৎস্যবিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে তুলেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, কোরাল মাছ জন্মায় উভলিঙ্গ পরিচয় নিয়ে। এরপর পুরুষ হিসেবে বাড়ে। আর বয়সকালে পরিণত হয় নারীতে। যদিও এই রূপান্তর কীভাবে ঘটে, বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো তা পরিষ্কার নয়।
তবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোজমের ভূমিকা প্রধান হলেও মাছের ক্ষেত্রে তা নয়। অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা জন্মের সময় যে লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে আসে, সচরাচর সেটাই তার আজীবন লৈঙ্গিক পরিচয় হয়ে রয়ে যায়। তবে মাছের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে না। উষ্ণ পানির অধিকাংশ মাছই জন্মায় পুরুষ হয়ে। এ ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ধারণে তাপমাত্রাও ভূমিকা রাখে। যুক্তরাজ্যের স্যালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক স্টিফানো মারিয়ানি দীর্ঘদিন ধরে মাছের এই অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, লিঙ্গ পরিবর্তনে মাছের পারদর্শিতা প্রাণিজগতে সবাইকে ছাপিয়ে যায়। গবেষণায় তিনি দেখতে পেয়েছেন, মাছেরা নিজেদের অ্যান্ড্রোজেন হরমোনকে দ্রুতই অ্যাসট্রোজেনিক হরমোনে রূপান্তর করতে পারে। এর ফলে তারা নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে।
বাংলাদেশে কোরাল মাছের ওপর প্রথম গবেষণা হয়েছিল ২০১৮ সালে। ওই বছরের এপ্রিল মাসে ‘ভেটকির মা মাছ তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় ওই গবেষণা। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা ওই গবেষণায় ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া যায়। আর গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের কলাতলী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত ২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরাল মাছের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করেন।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, কোরাল মাছ প্রথমে উভলিঙ্গ হয়ে জন্মায়। এরপর পুরুষ হয়। আর চার কেজির বেশি ওজন হলে অধিকাংশ কোরাল স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। রূপান্তরিত হওয়ার পরই স্ত্রী কোরাল প্রজননের জন্য গভীর সাগর থেকে উপকূলের নদী মোহনায় চলে আসে। কোরাল মাছের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় মে মাসে। একটি পরিপক্ব স্ত্রী কোরাল ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম।
সমুদ্রে উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে কোরাল মাছ পুরুষেই থেকে যায় বলে জানান সমুদ্রবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার। তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ পরিবেশ না থাকলে পুরুষ কোরালের শুক্রাণু প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, কোরালের প্রজননক্রিয়া ঘটে গভীর সাগরে। ডিমগুলো তখন সমুদ্রের পানিতে ভাসতে থাকে। ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিমগুলো লার্ভায় পরিণত হয়। লার্ভাগুলো স্রোতের টানে ভেসে সমুদ্র উপকূল ও নদীর মোহনায় চলে আসে। জীবনের শুরুতে এরা হারমোফ্রোডাইট (উভলিঙ্গ) থাকে। ওজন যখন ২০০ গ্রাম হয়, তখন সবাই পুরুষ জাতের হয়। তিন কেজি ওজন পর্যন্ত কোরাল পুরুষ থাকে। তিন কেজির বেশি ওজন হলে কোরালের মধ্যে রূপান্তর শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি চারটি পুরুষ থেকে একটি স্ত্রীতে পরিণত হয়। একটি পুরুষ থেকে যায়। এক বছর বয়সী কোরালের ওজন দাঁড়ায় চার থেকে সাড়ে চার কেজি। এ কারণে পূর্ণবয়স্ক কোরালের মধ্যে পুরুষ কোরালের সংখ্যা অনেক কম।
কক্সবাজারের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, কোরাল মাছ জন্ম নেয় পুরুষ হিসেবে। ওজন যখন চার কেজির বেশি হয়, তখন পুরুষ কোরাল আপনা-আপনি স্ত্রী জাতে রূপান্তর ঘটে। কিন্তু কোরাল পুরুষ হয়ে জন্মায় কেন এবং পুরুষ থেকে স্ত্রী জাতে রূপান্তর কেন ঘটে, এ নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়নি।