Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সুখ দেখে যেতে পারেননি মমতাজ বেগম

দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন সরওয়ার কামাল। ওমান গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন। একবছরের মধ্যে ফের সংযুক্ত আরব আমিরাত যান। গত দুই বছর ধরে সেখানে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। এখন আয় ভালো। একবছর আগে দুই কক্ষের সেমিপাকা বাড়ি করেছেন। ধীরে ধীরে সুখ ধরা দিচ্ছিল পরিবারে। কিন্তু সেই সুখ দেখে যেতে পারেননি সরওয়ারের স্ত্রী মমতাজ বেগম (৪৫)। পাহাড়ধসে বসতঘরের পাকা দেয়াল ভেঙে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান মমতাজ বেগম (৪৫), মেয়ে ময়না আকতার (১২) ও নাতি মো. তোহা (৮)।

আজ রোববার ভোর পাঁচটার দিকে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া এলাকার সেগুনবাগিচায় পাহাড়ধসে মৃত্যু হয় একই পরিবারের তিনজনের। তাঁদের লাশ উদ্ধারের পর দাফনের প্রস্তুতি চলছে। এঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া স্টেশন থেকে পাহাড়ি পথ ধরে এক কিলোমিটার গেলে সেগুনবাগিচা গ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে সংযুক্ত আরব আমিরাতপ্রবাসী সরওয়ার কামালের সেমিপাকা বসতঘর। পাহাড়ের একটি অংশ ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বসতঘরটির একটি কক্ষ। কক্ষটির খাটে ঘুমিয়েছিলেন মমতাজ বেগম, তাঁর মেয়ে ময়না আকতার ও নাতি মো. তোহা। বসতঘরটিতে দুই শিশুকে নিয়ে থাকতেন মমতাজ। স্থানীয় লোকজন মাটি ও পাকা দেয়ালের ভাঙা অংশ সরিয়ে এই তিনজনের লাশ উদ্ধার করেন। খাট, অন্যান্য আসবাবপত্র এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে।

ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ঘরটির ২০ফুট দূরত্বে পাহাড়ের পাদদেশে আরেকটি বসতঘর। এই ঘরটি নিহত মমতাজ বেগমের মা রাসু বেগমের (৬৮)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোর ছয়টার দিকে উঠে প্রথমে দেখি মমতাজের মুরগীর খাঁচার ওপর পাহাড় ধসে পড়েছে। দৌঁড়ে গিয়ে মমতাজকে ডাকি এবং মুরগির খাঁচা থেকে মাটি সরানোর চেষ্টা করি। একটু পরেই জানালা দিয়ে দেখি আমার মেয়ের চেহেরাটা শুধু দেখা যাচ্ছে। শরীরের বাকি অংশ, ময়না ও তোহার দেহ মাটির স্তুপের ভেতরে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে তাঁদের মরদেহ বের করা হয়।

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাসু বেগম। কান্না জড়িত কণ্ঠে রাসু বলেন, ‘আঁর মাইয়া সুখ ন দেখে। ২৫বছর ধরি শুধু হষ্ট গইজ্জে এক্কানা সুখর আশায়। এহন সুখর সময় তুই মরি গিয়সগই অ ঝি। অ ঝি রে ঝি। আঁত্তুন অসুখ অইলে তুই দৌঁড়ি আসতি। এহন হন আইবো…..’।

প্রতিবেশী হাসিনা বেগম (৫০) বলেন, গতকাল শনিবার দুপুরের দিকে মমতাজের রান্নাঘরের পাকা দেয়ালের ওপর পাহাড়ের একটি অংশ ধসে পড়ে। মমতাজ মাটি সরিয়ে ইটগুলো ওখানেই স্তুপ করে রাখে। পরে রাতে ঘুমিয়ে পড়লে পাহাড় থেকে পাশের আরেকটি অংশটি ধসে পড়ে মমতাজসহ তিনজনের প্রাণ গেছে। একটু সতর্ক হলে এই দুর্ঘটনাটি নাও ঘটতে পারত।

স্থানীয় লোকজন বলেন, মমতাজ তিনবছর আগে পাহাড়ের আরও চূড়ায় আরেকটি ঘর তৈরি করে বসবাস করেছিলেন। ওই ঘরটিও পাহাড় ধসে ভেঙে গিয়েছিল। বছর দেড়েক আগে আরেকটু নিচে এসে পাহাড় কেটে এই সেমিপাকা বসতঘরটি তৈরি করেন।

মমতাজের দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড়মেয়ে রিফা আকতারের বিয়ে হয়েছে। ছেলে মুবিনুল ইসলাম (১৮) টিউবওয়েল বসানোর কাজ করেন। ছোট মেয়ে ময়না আকতার ও রিফা আকতারের ছেলে মো. তোহাকে নিয়ে বসতঘরটিতে থাকেন মমতাজ।

মুবিনুল ইসলাম বলেন, আমি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় টিউবওয়েল বসানোর কাজ করি। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার মা, বোন ও ভাগিনা মারা গেছে। এখন আমার আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার বাবা ভালো আয় করছে, আমি আয় করছি। কিন্তু মা সুখ পাননি। সুখের সময় মা চলে গেছে।

শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হোসাইন বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে এভাবে বসতি তৈরি করে থাকার ফলে তিনটি প্রাণ হারাতে হয়েছে। এখানে পাহাড়ের পাদদেশে আরও অনেক বসতি রয়েছে। দ্রুত এসব সরিয়ে না নিলে আরও প্রাণ হারাতে হবে।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যাঁদের বসবাস পাহাড়ের পাদদেশে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তাঁদের দ্রুত সরে যেতে আহ্বান করা হয়েছে। ভারি বর্ষণে আরও পাহাড়ধস হতে পারে।

37Shares