👤 সমুদ্র সংবাদ ডেস্ক
কৃষিকাজ করে জীবনচাকা ঘোরান ফেনীর পরশুরামের বাহারখুমা গ্রামের আবদুল হক। এ বছর বোরো ধান লাগিয়েছিলেন তিন একর জমিতে; ছিল দুটি মাছের খামার। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কৃষক পরিবারটির সুখেই কাটছিল দিন। এখন সবকিছুই তাঁর কাছে দুঃস্বপ্ন। গত বুধবার রাতে হু হু করে পানি ঢুকে ডুবেছে স্বপ্নের ফসল, ভেসে গেছে মাছের খামার। বসতঘরটিও পানির নিচে। সহায়সম্বল হারিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে এক কাপড়ে একটি ট্রলারে চেপে ফেনী শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় ঠাঁই নিয়েছেন আবদুল হক।
আবু ইউসুফের বাড়ি ফেনীর ভাঙ্গা তাকিয়া বাজার এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে তাঁর বাস। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি চার ছেলের খোঁজে মহাসড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জানান, ছেলেরা তাদের স্ত্রীকে পানির ভেতর থেকে কোনোরকমে উদ্ধার করে সড়কে এসেছিলেন। এর পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ছেলেদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে ধারণা করছেন, অদূরের একটি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। তাঁর কৃষিজমি পানির নিচে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, তিনটি গরু, ৫০টির মতো মুরগি, ধানের গোলা।
টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে আবদুল হক আর আবু ইউসুফের মতো লাখ লাখ লোক এখন পানিবন্দি। বিশেষ করে ফেনী সদরসহ ছয় উপজেলা বানের পানিতে পুরোপুরি ডুবে আছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজীর। এসব উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাদের ঠিকানা হয়েছে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, স্থানীয় মসজিদ ও মন্দিরে। বিভিন্ন স্কুলের ছোট ছোট কামড়ায় জবুথবু হয়ে রয়েছেন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী ও পুরুষ, শিশু ও তরুণ। দুর্গত এলাকায় বুধবার রাত থেকেই বিদ্যুৎ নেই; নেই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় দুর্গম এলাকায় বাসিন্দারা কেমন আছেন, তা-ও জানা যাচ্ছে না।
ফেনীর পাশের ৩০ কিলোমিটার দূরের জেলা নোয়াখালীও এখন পানির নিচে। টানা বর্ষণে নোয়াখালীর আট উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ডুবে গেছে ফেনী-নোয়াখালী সড়কের চৌমুহনী-মাইজদী অংশের একাধিক এলাকা। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটে চলছে সবাই।
নোয়াখালী ও ফেনীর মতো একই দশা দেশের আট জেলার ৩৫৭টি ইউনিয়নে। কোথাও বুকপানি, কোথাও গলা অবধি। কেউ কেউ কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বুকপানিতে সাঁতরে উঁচু জায়গা খুঁজছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম অংশ পানিতে ডুবে যাওয়ায় গতকাল কয়েক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনীর ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আটজন। কুমিল্লায় চারজন, কক্সবাজারের রামুতে দু’জন, ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন করে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বন্যাদুর্গত আট জেলা হলো– ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লায় মানবিক বিপর্যয়
ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহিব উল্যার মানুষের জমিতে খেটে যা পান, তা দিয়েই সংসার চলে। বন্যায় তাঁর ঘুণে ধরা বেড়ার ঘরটি ভেঙে গেছে। শৌচাগার, রান্নাঘরও তলিয়ে গেছে। পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছেন ফেনী শহরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘এত বড় বন্যা হবে, তা কখনও ভাবিনি; প্রস্তুতও ছিলাম না।’ ফেনী শহরের বাসিন্দা মো. ইব্রাহীম জানান, তিন উপজেলার পর ফেনী শহরও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের বাসার নিচতলায় পানি ঢুকে যাওয়ায় ফকিরাহাট এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে ফেনী শহরের স্টেশন রোডের একটি হোটেলে উঠেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।
ফেনীর তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর লড়াই চলছে। ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট ও আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ, পৌর শহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যার পানিতে থইথই।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বলেন, ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এ ছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞার অনেক এলাকাও বন্যাকবলিত। পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ফেনীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উঁচু ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ফেনীর বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। সেখানে ৪০টি উদ্ধারকারী যান নিয়ে গেছেন ১৬০ সেনাসদস্য। স্থাপন করা হয়েছে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। কাজ করছে নৌবাহিনীর ৭১ সদস্য এবং আটটি উদ্ধারকারী যান। বিজিবিসহ অন্যদের নৌযান সেখানে নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, জুলাইয়ে শুরুতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়ে ১৫ স্থানে ভাঙে। সেসব স্থানে জোড়াতালি মেরামতের পর এ মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১১ স্থানে ভেঙে গিয়ে প্লাবিত হয় ১০০টির বেশি গ্রাম। যেখানে অবকাঠামো, ধান, ফসল ও মাছের ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ৩০ কোটি টাকার বেশি। সেই ক্ষত না শুকাতেই ১৫ দিনের মাথায় আবার বন্যা। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীন আক্তার বলেন, পরিস্থিতি এত দ্রুত খারাপ হয়েছে, আমাদের সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
গতকাল দুপুরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে দল বেঁধে আশ্রয়ের খোঁজে আসেন অনেকে। সঙ্গে তারা নিয়ে আসেন চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, শুকনা খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। কথা হয় চৌমুহনীর করিমপুর এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমানের সঙ্গে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি আশ্রয় নিতে এসেছেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বলেন, বাড়ির উঠানে কোমরপানি, ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই, তাই বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হাই স্কুলের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছি। একই এলাকার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের সড়কের হাঁটুপানি মাড়িয়ে সামনে এগোতে দেখা যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব মোহাম্মদ হারুনকে। তিনি বলেন, বসতঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। ঘরে বৃদ্ধ মা, তিন ভাইবোন ও স্ত্রী রয়েছেন। তাদের নিয়ে কোথাও যাব, সে উপায় নেই। ঘরের খাবারও ফুরিয়ে এসেছে। তাই খাবারের সন্ধানে ঘর থেকে বেরিয়েছি।
বেগমগঞ্জ পার হয়ে সেনবাগের দিকে যেতেই চোখে পড়ে বন্যার অভিন্ন ছবি। সেনবাগের এমপি রোডের মাথায় (হজনী খাল) দেখা যায়, নারী-শিশুসহ একটি পরিবারের সদস্যরা গাড়ির অপেক্ষায় আছেন। বেগমগঞ্জের শিবপুর গ্রামের বাসিন্দা এই পরিবার সেনবাগ উপজেলা সদরে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। গৃহকর্ত্রী জয়নব বেগম জানান, তাদের বাড়িঘর সবটাই পানি নিচে।
এদিকে ঢলের পানিতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জে ১০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে শত শত মাছের ঘের, আউশ ধান ও আমনের বীজতলা। এ ছাড়া আদর্শ সদর, লাকসাম, বুড়িচং, বরুড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও দাউদকান্দির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার নদীর চরতীরবর্তী শাকসবজির ক্ষেতসহ ফসল তলিয়ে গেছে। কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলা নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রামের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কুমিল্লার রুদ্র রূপ ধারণ করেছে গোমতী নদী। ২৭ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে গোমতীর পানি গতকাল বিকেলে বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে গোমতীর উভয় তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে। গোমতী ছাড়াও ডাকাতিয়া, কাকড়ী ও গুঙ্গুর নদীর পানিতেও পানি বেড়েছে। জেলায় ৫৮৭ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তিতাস উপজেলায় গোমতীর পানি বেড়ে বাঁধ ডুবে গেছে। ভেঙে গেছে আসমানিয়া বাজারসংলগ্ন একটি অস্থায়ী সেতু।
নাঙ্গলকোট উপজেলার কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, তিন দিন ধরে পানিবন্দি। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে পানি উঠেছে। প্রবল স্রোতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত কাঠের তৈরি সেতুটি ভেঙে গেছে। এতে ৪৩ গ্রামের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চান্দিশকরা এলাকার আহমেদুল হক জানান, গেল ৪০ বছরেও এমন পানি দেখেননি। পুকুর-বীজতলা সব পানিতে তলিয়ে গেছে। মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও এলাকার বাসিন্দা নূর হোসেন বলেন, ‘আমাদের অবস্থা ভয়াবহ। আজ কোনোরকম খেয়েছি। আগামীকাল কী হবে, কিছুই বুঝতেছি না।’
ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন
বন্যায় সড়ক এবং রেলপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রেলপথ ডুবে যাওয়ায় গতকাল ২৬ ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। ঢাকা থেকে সিলেটের এবং চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সন্ধ্যায় মহাসড়ক থেকে পানি নামার পর ঢাকা থেকে নোয়াখালী, ফেনীর বাস চলাচল শুরু হয়। মহাসড়ক বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখী পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশে প্রায় সাত কিলোমিটার হাঁটুপানিতে তলিয়ে গেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (কুমিল্লা জোন) আবু হেনা মো. তারেক ইকবাল বলেন, প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না ওই এলাকায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছাতে না পারায়। পানির কারণে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে রেলওয়ের অফিস আদেশে বলা হয়, বন্যায় পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন সেকশনে মাটি সরে রেললাইন বেঁকে গেছে। অতিবৃষ্টির কারণে ফাজিলপুর-কালীদহ সেকশনের রেলপথের পাথরসহ স্লিপার সরে গেছে। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-দোহাজারী-কক্সবাজার একই কারণে রেললাইন বেঁকে গেছে। শায়েস্তাগঞ্জ-লস্করপুর সেকশনের রেলসেতুর গার্ডার পর্যন্ত পানি ওঠায় ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ফেনীতে রেললাইন ও রেলসেতুর ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফেনী স্টেশনে পানি উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে সুবর্ণ ও চট্টলা যাত্রা করতে পেরেছিল। কিন্তু সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করা পাহাড়িকা এক্সপ্রেস বন্যার কারণে ফেরত আনতে হয়েছে।
পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ
আগের রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কোমরপানি জমে যায়। দুপুরের পর পানি কিছুটা কমতে শুরু করে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। নগরীর পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। খোলা হয়েছে ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম নগরী ছাড়াও ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, হাটহাজারী, কর্ণফুলী, পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী ও রাউজান উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। হালদা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের কারণে পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে ৩৫টি নৌযান নিয়ে কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। পুরো জেলায় খোলা হয়েছে ১২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র।
মিরসরাইয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। সাতকানিয়ার বিভিন্ন গ্রামও এখন প্লাবিত। হাতিয়া ও ডলু খালের পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। কাঞ্চনা ইউনিয়নের গজছড়ি খালের ওপর নির্মিত স্লুইসগেট ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গুলিয়াখালী উপকূলীয় বেড়িবাঁধ গতকল ভাঙনের কবলে পড়েছে। বাঁধ মেরামতে শত শত মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন।
এদিকে, খাগড়াছড়িতে গত বুধবার দিনভর বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছে চেঙ্গী ও মাইনী নদীর আশপাশের জনপদের সহস্রাধিক পরিবার। জেলায় ১০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন।
বন্যায় রাঙামাটিতেও হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। এ জেলায় ২২২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল জেলার তিনটি সড়কের ২১টি স্থানে ছোট-বড় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছে প্রশাসন। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে কাপ্তাই হ্রদে পানি অনেক বেড়েছে। তবে বাঁধের পানি এ মুহূর্তে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না।
কক্সবাজারে জোয়ারের পানি আর পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতাধিক গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে ঈদগাঁও, চকরিয়া-পেকুয়া আর রামুতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মহেষখালীতে দু’জন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় গতকাল বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাঁচটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি। হাওড়া বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে গেছে। স্থলবন্দর এলাকায় পানি ওঠায় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে দুর্গতদের মধ্যে শুকনো খাবার, চিড়া, গুড়, স্যালাইন বিতরণ করা হয়েছে। কসবার বায়েক ও গোপীনাথপুর ইউনিয়নে এখন ৫০০ পরিবার পানিবন্দি। দুর্গতদের জন্য পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে খোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজারে মনু নদীর পানি চাঁদনীঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা শহররক্ষা বাঁধ উপচে ও গাইডওয়াল চুয়ে বুধবার রাতে শহরে পানি প্রবেশ করছিল। পাউবো কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রাত জেগে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান সংস্কারের চেষ্টা করেন। কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে বুধবার রাতে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। শমসেরনগর-ব্রাহ্মণবাজার প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দি প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ।
ভারী বর্ষণে ঢাকার দোহারে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে। নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে বন্যা। উপজেলার তিন ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। খুলনার পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে গতকাল দুপুরে বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় ছয় হাজার মানুষ।