কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় দিল্লির মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তথা বাদশাহ আলমগীর মৌলভী সাহেবকে ডেকে তিরস্কার করেছিলেন, তার সন্তান কেন শিক্ষকের পায়ের ধুলাপানি ঢেলে হাত দিয়ে পরিষ্কার করেননি। বর্তমান সময়ে শিক্ষকের মর্যাদা ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির’- এমন বাক্য বন্ধে আবদ্ধ নেই। কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পের কথাই যদি বলি, লাট সাহেবের ট্রেনে কাটা পড়া ‘তিন ঠ্যাঙওয়ালা’ কুকুরের পেছনে এক মাসের খরচ হয় পঁচাত্তর টাকা; যার বিপরীতে স্কুলের পণ্ডিতমশাইয়ের আটজনের সংসার চালাতে এক মাসের বেতন পঁচিশ টাকার হিসাবের মতো কঠিনও নয়, আমাদের এখনকার শিক্ষকদের জীবন।
শিক্ষকদের সেই মর্যাদা হয়তো নেই, কিন্তু তাদের প্রতি ছাত্র-অভিভাবকদের আস্থা কিংবা ভক্তির অভাব নেই। আবার আয়ের দিক থেকে কঠিনও নয় তাদের জীবন। এসবের পরও সমাজ ও প্রজন্মের মানস গঠনে শিক্ষক ও শিক্ষকতার বিকল্প নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থী ও সুযোগসন্ধানীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার খবরে যারপরনাই দুঃখ ও হতাশা ভর করে মনে।
বর্তমানে দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রায় ৪৪ লাখ। চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের কারণে গত ১৭ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগের পর এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য (ভিসি), সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করতে শুরু করেন। কেননা, তারা সবাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল-কলেজগুলোর চিত্রও ব্যতিক্রম নয়। ঢাকার কথাই যদি বলি, গত দুই সপ্তাহে অন্তত ৪০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পদ ছেড়েছেন। তারা কেউ স্বেচ্ছায় এবং কেউ চাপের মুখে পদ ছেড়েছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছেÑ এমন নজিরও আছে। এ ছাড়া বরখাস্তও হয়েছেন কয়েকজন।
গত ১১ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস থেকে ৩৬ জন প্রধান শিক্ষকের পদ হারানোর বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। যাদের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন আটজন, পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ২০ জন, পলাতক তিনজন, বাধ্যতামূলক ছুটিতে তিনজন, অপসারিত হয়েছেন একজন এবং আন্দোলনের মুখে বাসভবন ছেড়ে পালিয়েছেন একজন।
দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সরিয়ে দিতে বিক্ষোভ কিংবা জোরজবরদস্তি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এসবের হিসাব রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে তাকে চেয়ার থেকে নামাতে ও পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করাতে জোরাজুরি করছে একদল শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষিকা এক ছাত্রীকে চড় মারেন। তবু শিক্ষার্থীরা তাকে চেয়ার থেকে নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।
গত ২৯ আগস্ট বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুকলা রানি হালদারকে পদত্যাগে বাধ্য করে একদল শিক্ষার্থী। তাদের দাবির মুখে, সাদা কাগজে শুধুমাত্র দুই শব্দ ‘পদত্যাগ করলাম’ লিখে স্বাক্ষর করে নিচে সিল দেন অধ্যক্ষ। তার বিরুদ্ধে কলেজের তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে অসদাচরণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ আগস্ট শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে তিনি নিজ কার্যালয়ে জ্ঞান হারান। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, তিনি স্ট্রোক করেছেন।
অধিকাংশ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সামনে দেখা গেলেও অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘটনায় নেপথ্যের ইন্ধন রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক পদগুলো দখল করতে শিক্ষকদের আরেকটা অংশই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন। পদত্যাগে বাধ্য করা শিক্ষকদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া থাকলেও কিছুই মানা হচ্ছে না।
সম্প্রতি যে কথা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্বরতদের জোর করে পদত্যাগ করানোর সুযোগ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কারেও বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে।’ একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে অপমানিত করা যাবে না।’
প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার বিপরীতে আছে ভিন্ন ঘটনাও। পদত্যাগ করতে চাওয়ায় বিক্ষোভও করছেন শিক্ষার্থীরা, এমনও ঘটেছে। গত ১৮ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করবেন এমন গুঞ্জনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা উপাচার্যের দপ্তর অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ ছাড়া কয়েকটি স্কুল-কলেজের প্রধানরা পদত্যাগ করার পর শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মানববন্ধন ও আন্দোলনে তারা স্বপদে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
বলাই বাহুল্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ ভিসির বিরুদ্ধে ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানাবিধ অভিযোগ। তাদের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিরোনাম হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। অনেকের বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটিও। তবুও দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট এসব শিক্ষক স্বপদে বহাল ছিলেন।
কিংবা আরেকটু পেছনে যদি যাই, ২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠ-বস করানোর ঘটনায় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের শাস্তি হয়নি। কিংবা বিনা অপরাধে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের জেলখাটা, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জুতার মামলা পরানো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপককে হেনস্থার ঘটনাগুলো দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দিলেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে শুধু দুঃখ প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ছাড়া উল্লেখ করা যায়, চলতি বছর কুমিল্লা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে শিক্ষকরা অপমানিত হওয়ার কথাও।
ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটাও অপরাধের শামিল। শিক্ষকদের প্রতি বর্তমান সময়ের লাঞ্ছনা কখনই কাম্য নয়। যদি কেউ সত্যিই দুর্নীতি বা অপরাধে জড়িত থাকেন, তার বিচার হোক। হাতে গোনা কয়েকজনের জন্য গোটা শিক্ষক সমাজের গায়ে কালিমা লেপন ভবিষ্যতের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথকে আরও জটিল করে তুলবে বলেই মনে করি। তাই শিক্ষকদের মর্যাদা, তাদের প্রাপ্য সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব সবার। একই সঙ্গে শিক্ষকরাও ‘শিক্ষাগুরুর শির’ কীভাবে চির উন্নত রাখা যায়, সে বিষয়েও যত্নবান হবেন নিশ্চয়ই।