👤 নিজস্ব প্রতিবেদক ,কক্সবাজার
কক্সবাজারে গতকালের তুলনায় আজ শনিবার বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তবে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে কক্সবাজার শহরে জলাবদ্ধ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও বেড়েছে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে এখনও জেলা সদরসহ ৬ উপজেলার ২ শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৮টি ফিশিং ট্রলারসহ অন্তত ৭০ জেলে নিখোঁজের তথ্য জানিয়েছে মালিক সমিতি। এর মধ্যে ৩ জনের মরদেহ উপকূলে ভেসে এসেছে।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, পেঁচারদ্বীপ ও কলাতলী উপকূল থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান বলেন, শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়; যা কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্টে ৪৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।
গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কম হওয়ায় কক্সবাজার শহরের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল মোটেল এলাকার সকল সড়ক, সৈকতসংলগ্ন এলাকা, মার্কেট এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাাঁচা মিয়ার ঘোনা, পাহাড়তলী এলাকা থেকেও জলবদ্ধতা নেমে গেছে।
তবে শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়াসহ ৮টি নিমাঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া এলাকাটি নিম্নাঞ্চল। সমুদ্র উপকূলের এসব এলাকার দশ হাজার ঘরবাড়ি এখনও পানিবন্দি।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, বৃষ্টি কমে যাওয়ায় হোটেল মোটেল জোন এখন পানি নেমে গেছে। তবে বৃষ্টি হলেই এখন আতংক তৈরি হচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। নালা উন্নত করা না হলে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।
অপরদিকে উখিয়া উপজেলার ৪০টির বেশি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি থাকার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। উখিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হলদিয়াপালং ও জালিয়া পালং ইউনিয়নে।
এই দুই ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ গত দুই দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় রান্না হচ্ছে না অধিকাংশ ঘরে।
জালিয়া পালং ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া, ঘাটঘর পাড়া পাইন্যাশিয়া, সোনাইছড়ি, সোনারপাড়া ডেইপাড়া মনখালি, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়া, মনির মার্কেট, রুমখা পালং, বড়বিল, পাতাবাড়ি, নলবুনিয়া, খেওয়া ছড়ি, বৌ বাজার, কুলাল পাড়া, পাগলির বিল, রাজা পালং ইউনিয়নের কুতুপালং, মাছকারিয়া, লম্বাশিয়া তুতুরবিল, পিনজির কুল, রত্না পালং ইউনিয়নের সাদৃ কাটা, পশ্চিম রত্না, খোন্দকার পাড়া, গয়াল মারা ও পালংখালী ইউনিয়নে থাইংখালী, রহমতের বিল, বালুখালী তৈল খোলা, আঞ্জুমান পাড়া ফারিবিলসহ অন্তত ৪০টি গ্রামে পানি তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী বলেন, বন্যায় উপজের ৫ ইউনিয়নে অনেক এলাকার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। জালিয়া পালং ও হলদিয়াপালং ইউনিয়ন এর মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হলদিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, দুই মাসের ব্যবধানে ৪ দফা বন্যায় তার ইউনিয়নের ২০টির বেশি গ্রামের মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভির হোসেন বলেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য জেলা থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমেও সহযোগিতার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে বৃষ্টিতে চকরিয়া-পেকুয়ার বিভিন্ন নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, বিএমচর, কোনাখালী ও বদরখালী ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি রয়েছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষ। এসব এলাকার আমন ও শীতকালীন সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে।
মানকিপুর-সুরাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, মানিকপুর এলাকায় বৃষ্টিতে নিচু এলাকার ২ শতাধিক ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ছালেকুজ্জামন বলেন, আমার ইউনিয়নের পহরচাঁদা, গোবিন্দপুর ও ডেইঙ্গাকাটা এলাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের নিরাপত্তা ও শুকনো খাবার বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে পেকুয়ার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের ১০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এলাকার খোঁজখবর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে ও নদীর তীরবর্তী অবস্থানরত লোকজন নিরাপদে সরিয়ে যেতে উপজেলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
পেকুয়ার শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, তিন দিনের টানা বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কিছু বসতঘর ও দোকান-পাটে পানি ঢুকেছে।
এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ৮টি ফিশিং ট্রলার নিখোঁজ থাকার তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে নিখোঁজ থাকা এসব ট্রলার ডুবে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিছু জেলে সাঁতার কেটে উপকূলে ফিরেছে। তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এসব ট্রলারের আরও অন্তত ৭০ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
শনিবার সকালে কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক, পেঁচারদ্বীপ ও কলাতলী উপকূল থেকে উদ্ধার হওয়া মৃত তিনজনের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, বাঁশখালী উপজেলার শেখেরকিল এলাকার নুরুল আমিন ও লোহাগাড়া উপজেলার চরমবা এলাকার মোহাম্মদ জালাল।
অপর একজনের পরিচয় পাওয়া না গেলে মরদেহ ৩টি কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আশেকুর রহমান।