গতকাল বুধবার প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ফলাফল। সেই ফলাফলে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন মোহাম্মদ ওয়াসিম। যিনি চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তাকে জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রথম ‘শহীদ’ বলা হয়।
ছেলে পাস করেছে শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ওয়াসিমের মা জোসনা বেগম, কাঁদছে তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরাও। আনন্দের পরিবর্তে ওয়াসিমের কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজারপাড়া এলাকার বাড়িতে এখন শোকের আবহ। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার সবই আছে, শুধু নেই ওয়াসিম। গতকাল রেজাল্ট দিয়েছে। সেই কাগজটি আমাকে একজন দিয়েছে। সবাই বলছে সে ভালো রেজাল্ট করেছে। শুনে খুশি লাগছে। তবে খারাপ লাগছে আরও বেশি। আমার ভেতরে দুমড়ে মুসড়ে যাচ্ছে। আমি থাকতে পারছি না আমার বুকের ধনকে ছাড়া। সে বেঁচে থাকলে কত আনন্দ করতো, খুশি হতো। তা দেখে গর্ব করতাম আমিও।’
গত ঈদের পরপরই শুরু হয় পরীক্ষা। একারণে গ্রাম থেকে খুব কম সময়ে শহরে চলে গিয়েছিলেন ওয়াসিম। প্রতিটি পরীক্ষার আগেই মাকে ফোন দিয়ে দোয়া নিয়ে তারপর হলে ঢুকতেন। সেসব বলে অঝোরে কেঁদে উঠেন জোসনা বেগম। তিনি বলতে থাকেন, ‘বাড়ির পাশেই কবরস্থানে মাটির নীচের ঘরে শুয়ে আছে ছেলেটা। মনে হয়, এখনই আমার কাছে ফিরে আসবে রেজাল্টের কাগজ নিয়ে। বলবে, দেখো মা আমি পাস করেছি। তোমার দোয়া কাজে লেগেছে। এবার আমি চাকরি করবো।’
১০ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওয়াসিমের ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিন মনের আঙিনা থেকে ভাইকে এক মিনিটের জন্যও আড়াল করতে পারে না। সে বলল, ‘ভাইয়া সবসময় পড়াশোনা করতে বলত। আমার সামনে ভাইয়া নিজেকে উদাহরণ হিসেবে টানত। আজ ভাইয়া নাই হয়ে গেছেন। আমি বেঁচে আছি। ভাইয়ার রেজাল্ট আমি দেখছি, সে দেখতে পারছে না।’
মোহাম্মদ ওয়াসিম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৬ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব নির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু এর আগেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ স্টেশন চত্বর দখলে নেয়। ওই সময় ছাত্র-জনতা মুরাদপুরে সমবেত হয়।
বিকেল পৌনে তিনটার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। ওইদিন ওয়াসিমসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অন্তত দেড়শ ছাত্র-জনতা। নিহত বাকি দুজন হলেন- নগরের ওমর গনি এমইএইচ কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল হোসেন ও ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ফারুক হোসেন।
মৃত্যুর একদিন আগে ১৫ জুলাই নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে ওয়াসিম লেখেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আমার প্রাণের সংগঠন। আমি এই পরিচয়ে শহীদ হব।’
নিহত ওয়াসিমের সৌদি প্রবাসী বাবা শফিউল আলম ও মা জোসনা আক্তার। দুই ভাই ৩ বোনের মধ্যে ওয়াসিম দ্বিতীয়। তিনি ২০১৭ সালে কক্সবাজারের পেকুয়ার মেহেরনামা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে ফলের অপেক্ষায় ছিলেন ওয়াসিম। কিন্তু সেই ফল প্রকাশের আগেই আন্দোলনে নিহত হন তিনি।
গত ১৮ আগস্ট নিহত ওয়াসিমের মা জোসনা নগরের পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলসহ ১০৮ জনকে আসামি করা হয়।
ওয়াসিমের সেই রেজাল্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে তাকে স্মরণ করছেন সহপাঠী, বন্ধু ও তাঁর মৃত্যুতে শোকার্ত লোকজন। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
ফলাফলের ছবি পোস্ট করে সামিয়াত আমিন নামে একজন লিখেছেন, ‘আজ প্রকাশিত অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট অনুযায়ী চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শহীদ ওয়াসিম আকরামের রেজাল্ট এসেছে! কিন্তু সে আর আসবেনা কোন দিন! দেশের জন্য তার আত্মত্যাগ জাতি কি মনে রাখবে?!!’
এম ইয়াসিন মাসুদ নামের একজন ফলাফলের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন ‘চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের ওয়াসিম একাডেমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই আমাদের স্বাধীন করার যুদ্ধে জীবন দিয়ে শহীদ হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।’
আলীফ মোহাম্মদ নামের একজন লিখেন, ‘আমাদের শহীদ মুহাম্মদ ওয়াসিম! শাহাদাতের পর রেজাল্ট আসলো প্রমোটেড! দুনিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের জন্য স্বাধীন ভূমি রেখে গেছে।নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতে প্রমোটেড করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। সেই দোয়া করি, আমীন।’