Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বদরখালীতে ১২ একর প্যারবন নিধন, ৩০জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকায় ১২ একর প্যারাবন নিধনের দায়ে ৩০জনের নামে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) চকরিয়া থানায় মামলাটি করেন কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কেমিস্ট মো. আবদুছ ছালাম। মামলায় ১০-১২জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত বছরের ২০ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারির মধ্যে আসামিরা বদরখালী বাজারের দক্ষিণে টুটিয়াখালী পাড়ার পশ্চিমে ১০ একর ও বদরখালী-মহেশখালী ব্রিজের দক্ষিণে দুই একর প্যারাবন নিধন করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১২একর প্যারাবন নিধনের সত্যতা পান। মাছের ও কাঁকড়ার ঘেরের জন্য বাঁধ তৈরি করতে এসব প্যারাবন নিধন করা হয়। গত ১৩ জানুয়ারি বদরখালী ব্রিজের দক্ষিণে মহেশখালী চ্যানেলের পূর্ব পাশে দুই ফুট উচ্চতা, পাঁচ ফুট প্রস্ত ও ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। আসামিরা প্যারাবন নিধন করে শ্রমিক দিয়ে খালের মধ্যে এই বাঁধ তৈরি করেছেন। খালের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের ফলে জলাশয় এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারত্মক ক্ষতি হয়েছে।

মামলায় বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য গোলাম কাদের ওরফে মনু ও সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম ওরফে ভুট্টুকে আসামি করা হয়। এছাড়া মামলায় ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রহিমকেও আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় রয়েছেন আব্দুল কাদের, সাহাব উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। তাঁরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির সাবেক সম্পাদকও ছিলেন।

গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘেরের বাঁধ’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের নির্মাণের খবর প্রকাশের পর ১৭ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহিদ হোসাইন স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা করেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত প্রতিবেদন দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালককে নির্দেশ দেন। কাগজে-কলমে পরিবেশ অধিদপ্তর ২২ মার্চ প্রতিবেদনে সাক্ষর করলেও সেই প্রতিবেদন আদালতে পৌঁছে ২৪ সেপ্টেম্বর। সেই প্রতিবেদনে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বাদ দিয়ে ১৩জন নিরীহ ব্যক্তির নামে আদালতে প্রতিবেদন অভিযোগ উঠে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে প্যারাবন নিধনের ঘটনায় যে ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা কেউ লবণচাষি, কৃষক, নৈশপ্রহরী ও দোকানের কর্মচারী।

এনিয়ে গত ১০ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইনে ‘দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরের’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনের জেরে প্রথম আলো গত ২১ অক্টোবর ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কেমন প্রতিবেদন’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তখনই নড়েচড়ে বসে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই দিনই কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কেমিস্ট মো. আবদুছ ছালাম সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্যারাবন নিধনের স্থান পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর ৩০জনকে আসামি করে গত ২৩ অক্টোবর চকরিয়া থানায় মামলা করেন তিনি।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী উপকূলে কয়েক শ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। এরপর জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বদরখালী নদীতীরের ৩ কিলোমিটারজুড়ে ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৩ ও ২০১৯ সালে ৪ দফায় অন্তত ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইন গাছের চারা রোপণ করে বেসরকারি সংস্থা উবিনীগ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গাছগুলোর উচ্চতা দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ ফুট। কিন্তু এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় শতাধিক দখলদার কয়েক দফায় হাজারো গাছ কেটে চিংড়ির ঘের নির্মাণ করেন। দখলদারদের সবাই কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের অনুসারী।

উবিনীগের আঞ্চলিক সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন খান বলেন, আদালতের আদেশে যখন দখলদারদের বিষয়ে তদন্ত চলছিল তখন উবিনীগের পক্ষ থেকে প্যারাবন নিধনে জড়িত অন্তত ৪০ জনের একটি তালিকা এবং প্যারাবন নিধনের ভিডিও চিত্র পরিবেশ অধিদপ্তরে সরবরাহ করা হয়েছিল। ভিডিওতে প্যারাবন নিধনকারী ব্যক্তিদের সহজে শনাক্ত করা যায়। এরপরও প্রকৃত দখলদারদের নাম বাদ দিয়ে নিরীহ ও দরিদ্র ১৩ জনের নামে প্রতিবেদন দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। অথচ থানায় করা মামলায় উবিনীগের সরবরাহ করা তালিকার ৩০জনকে আসামি করা করা হয়েছে।

চকরিয়া থানায় রুজু হওয়া মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনের সঙ্গে চকরিয়া থানায় করা মামলার আসামিদের মধ্যে একজনের নামও মিল নেই। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বলেছিলেন, সরেজমিন অনুসন্ধান করে প্যারাবন নিধনের সঙ্গে তিনি যাঁদের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। উবিনীগের পক্ষ থেকে যাঁদের তালিকা জমা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁদের সম্পৃক্ততার বিষয়েও কেউ সাক্ষ্য দেয়নি।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের ভূঁইয়া বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে ৩০জনের নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) ১৫(১) টেবিলের ৮ ও ১২ধারায় একটি মামলা করেছেন। মামলাটি পরিবেশ অধিদপ্তরই তদন্ত করবে।

3Shares