Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পেকুয়ার ‘ত্রাস’ জাহেদ চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার, এলাকায় স্বস্তি

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রামু উপজেলার বাইপাসের ফুটবল চত্ত্বর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর গ্রেপ্তারের খবরে এলাকায় স্বস্তি বিরাজ করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, জাহেদ চেয়ারম্যান চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের ‘ডানহাত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংসদ সদস্যের প্রভাব খাটিয়ে টৈটং এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন জাহেদ।

র‍্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

র‍্যাব জানিয়েছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‍্যাবের আভিযানিক দল জানতে পারে, টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে রামু এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রামু বাইপাসের ফুটবল চত্ত্বর এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাহেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।র‍্যাব বলছে, জাহেদ চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের অন্যতম সহযোগী। ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে তিনি টৈটং এলাকায় অস্ত্র ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জোরপূর্বক ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতেন।

পেকুয়া থানা পুলিশ জানায়, জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় ওয়াসিম হত্যা মামলা, চকরিয়ায় বিএনপির গাড়ি বহরে হামলা ও হত্যা চেষ্টা এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টৈটং বটতলী শফিকিয়া মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে বিএনপি কর্মীকে হত্যা চেষ্টা মামলা রয়েছে।

টৈটং ইউনিয়নের ত্রাস জাহেদ চেয়ারম্যান

গত ২০ বছর ধরে জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী টৈটং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি গঠন করেন স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ‘দা বাহিনী’। এই বাহিনীর মাধ্যমে তাঁর অবস্থান জানান দিতে থাকেন জাহেদ। এলাকায় ভূমি দখল, পাহাড় দখল, চাঁদাবাজি, দোকান দখল, মানুষের ভিটে-বাড়ি দখল, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব। তাঁর ও তাঁর বাহিনীর ভয়ে মানুষ চুপসে যায়। ২০১৫ সালে তাঁর মামা পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সাহাব উদ্দিন ফরায়েজি হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে কপাল খুলে যায় জাহেদের। তাঁর সব প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষকে মামলাটিতে আসামি করে ও আসামি করার ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করেন। এরপর আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাহেদ। চেয়ারম্যান হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। বাড়িয়ে দেন নির্যাতনের মাত্রা। জায়গা দখলে বাধা দেওয়ায় দা বাহিনীর হাতে খুন হন টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দুইবারের ইউপি সদস্য আব্দুল জলিলের বাবা। চুরির অভিযোগ তুলে এক যুবককে প্রকাশ্যে রাস্তার ওপর ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান জাহেদ। এরকম আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে জাহেদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, টৈটং বাজারের পাশে জাহেদ চেয়ারম্যানের নতুন বাড়ি। সেই বাড়ির ‘গোলঘর’টি টর্চারসেল নামে পরিচিত। কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই কোনো কথা ছাড়া ধরে নিয়ে গোলঘরে চলত নির্যাতন। কেউ মামলা করার সাহস পেতেন না। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন সন্ধ্যায় মানুষের ক্ষোভ আচড়ে পড়ে সেই গোলঘরটির ওপর। সেটিতে অগ্নিসংযোগ করার পাশাপাশি তাঁর বসতঘরেও আগুন দেয় স্থানীয় জনতা।

টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মোসলেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জাহেদ একাধারে চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্যের অত্যন্ত আস্তাভাজন ছিলেন। তাঁর কথায় থানা পুলিশ উঠত আর বসত। টৈটংয়ে গত ১৫বছর তিনি ছিলেন শেষ কথা। তাঁর কথার ওপরে কেউ কথা বললে নির্যাতন আর মামলার খড়ক নেমে আসত। সবাই ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। তবে তিনি মনে করেন, ৫ আগস্টের পরে জাহেদের সাম্রাজ্যে ধস নেমেছে। এখন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। আশা করা যায়, এলাকায় স্বস্তি ফিরবে।

চাল আত্মসাতে বরখাস্ত, ক্ষমতার দাপটে একবছরেই সব ঠিক

করোনার সময় মানবিক সহায়তার ১৫টন চাল আত্মসাত করে আলোচনায় আসেন টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। প্রথম আলোর শেষ পাতায় ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল ‘১৫টন চাল গেল কোথায়? শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত হন জাহেদ এবং টৈটংয়ের চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। কালোবাজারির অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেও তাকে অব্যহতি দেয়া হয়। এরপর আত্মগোপনে চলে যান জাহেদ চেয়ারম্যান। বছর না ঘুরতেই সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এলাকায় ফেরেন। অব্যহতি পান মামলা থেকে। শূন্য চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ তাকে আবারও মনোনয়ন দেয়। এতে খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেই বিষ্ময় তৈরি হয় তাঁর ক্ষমতার প্রভাব নিয়ে। এ নিয়ে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ প্রথম আলোতে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, ‘চাল আত্মসাতে বরখাস্ত, তিনিই পেলেন মনোনয়ন’ শিরোনামে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি আবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ৫ আগস্টের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমি থানায় যোগদান করি। এরপর জাহেদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যাঁরাই থানায় অভিযোগ নিয়ে এসেছেন, আমি মামলা ও আইনী পদক্ষেপ নিয়েছি।

ওসি বলেন, জাহেদ চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত (সকাল আটটা) র‍্যাব তাকে থানায় হস্তান্তর করেনি।

0Shares