Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সত্যের পথই আমার পথ

আমার শিক্ষক-জীবন প্রায় ছয় দশক (১৯৬৫-২০২৪)। এই দীর্ঘসময়ে বাংলাদেশ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে এই ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সার্টিফিকেট নিইনি। কারণ, এটি ছিল আমার মহান কর্তব্য, জীবনের বিনিময়ে হলেও। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার অনেক লেখা আছে। ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বইও আছে আমার। ১৯৬৫-৬৬ সালে বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর শিক্ষকতা করেছি। ১৯৬৯ সালে আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিই। ২০০৬ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করি। এরপর যোগ দিই উপাচার্য হিসেবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০১ সালে যখন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ছিলাম। ২০০১ সালে বিএনপির শাসনামলে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পায়।

১৯৪০ সালে আমার জন্মের শেষার্ধ থেকে এই দেশ নানা উত্থান-পতন, সংগ্রাম, বিক্ষোভ-বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। বর্তমানে এই দেশে বৈষম্য অবসানের যে বিদ্রোহ চলমান, সেই বিদ্রোহে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই শিক্ষক-নেতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তখন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষারত (তিনি আমার এক বছর সিনিয়র ছিলেন)। সেই সময়ে তার ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর স্ত্রী জওশন আরা সম্পাদিত ‘দু’পাতা’ ম্যাগাজিনে আমার লেখক-জীবনের সূচনা হয়। যতটুকু মনে পড়ে, একই সংখ্যায় ড. ইউনূস সুন্দর একটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন। এরপর থেকে অসংখ্য লেখা লিখেছি। ১৯৮০-র দশকে ইংল্যান্ডের সুবিখ্যাত একটি প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত আমার একটি গ্রন্থের (গুগল স্কলার দ্রষ্টব্য) প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সুবিখ্যাত অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান, যিনি ড. ইউনূসেরও শিক্ষক। এই গ্রন্থটি ইউরোপ ও আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকায় রেফারেন্স হিসেবে রয়েছে, সহস্রাধিক লাইব্রেরিতে রয়েছে (গুগল দ্রষ্টব্য)।

এখন দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতার কারণে আর তেমন লিখতে পারি না। এখন লিখতে অনুলেখকদের সাহায্য প্রয়োজন হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ইউনূস যখন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান, তখন বেশ কয়েক বছর তার বিভাগের পাশের বিভাগ সমাজতত্ত্বে আমি তার সহকর্মী ছিলাম। তার ‘ম্যাগাসাস’ পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে ড. মঈনুল ইসলাম, আবুল মোমেন প্রমুখরা যখন তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, তখন সেই সংবর্ধনা সভায় আমিও একজন বক্তা ছিলাম। এছাড়া আরো কয়েকটি সভায় তার সঙ্গে একসঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছি। দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদের সভাপতিত্বে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ইনফরমেশন টেকনোলজি যে সভ্যতাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিচ্ছে, এ সম্পর্কে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি যে বক্তৃতা করেন, সেই সভায়ও বিশেষ অতিথি হিসেবে আমি বক্তা ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমাদেরই দলভুক্ত ছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে, তাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর করার জন্য সিনেট থেকে আমাদের দল থেকে নাম প্রস্তাব করে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংক যখন তার কর্মযজ্ঞের মধ্যাহ্নে, সেই সময় এক বিরাট বন্যা হয়। সেই বন্যায় গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের বড় ধরনের ক্ষতি হলে, তারা ঋণ পরিশোধে প্রায় অক্ষম হন। ড. ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তাদের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য ৪০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিলেন। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. ফরাস উদ্দিন। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য ছিলাম। এই প্রস্তাব বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সভায় উপস্থাপন করা হলে আমরা উৎসাহের সঙ্গে সর্বসম্মতিক্রমে তা সমর্থন করি। আমি আমার বিভিন্ন গ্রন্থে কোনোসময় ক্ষুদ্রঋণকে সমর্থন করেছি, আবার কোনোসময় সমালোচনাও করেছি।

২ কী ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা আমার বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দিয়েছে, সেখানে একটি লিংকে দেখলাম, বিদেশি অনেক নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের পক্ষে একটি মামলা স্থগিত করার জন্য যে আপিল করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ১৭১ জন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী আপত্তি জানিয়েছেন। তার মধ্যে আমার নাম দ্বিতীয় কী তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আরো রয়েছে অধ্যাপক নজরুলের নাম, যিনি ইউজিসির চেয়ারম্যান ছিলেন। রয়েছে প্রফেসর সনৎকুমার সাহার নাম ও আরো অনেকের নাম। আমি এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র অবগত ছিলাম না। কে বা কারা আমার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি সেই সময় আমার চোখের হেমারেজ বা রক্তক্ষরণের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম। এই বিষয়ের ব্যাপারে কিছুই অবগত ছিলাম না। অনেক বিবৃতিতেই অনেক সময় আমাদের না জানিয়ে আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুঃখের বিষয়, আমাকে না জানিয়ে আমার নাম নানা বিবৃতিতে অনেকে অন্তর্ভুক্ত করে এসেছেন, যা আমি জানতে পারিনি।

আমি সব সময় সত্যের পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। আমি মানসিকভাবে দার্শনিক কার্ল মার্কসের অনুসারী। দার্শনিক কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তার সম্পূর্ণ প্রয়োগ এ পর্যন্ত কোনো দেশেই হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নেও নয়, চীনেও নয়। একটি বাক্যে তার দর্শনের মূল সারাংশ এইভাবে ব্যক্ত করা যায়- ‘ঋৎড়স বধপয ধপপড়ৎফরহম ঃড় যরং ধনরষরঃু, ঃড় বধপয ধপপড়ৎফরহম ঃড় যরং হববফং.’- তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ, যেখানে ক্রমশ অসাম্যের বিলোপ ঘটবে, বৈষম্যের অবসান হবে। প্রত্যেকে তার সুন্দর জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন (হববফং) অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্ম, অবসর ও বিশুদ্ধ বিনোদনের অধিকার পাবে। আমি আমার অনেক গ্রন্থেই তার দর্শনের প্রয়োগ করেছি। আমার শেষ গ্রন্থটি হলো ‘অসাম্যের বিশ্বে সাম্যের স্বপ্ন’। আমি এই গ্রন্থে অসাম্যের বিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েছি। তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছি। আওয়ামী লীগ শাসনের শেষ কয়েক বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য যে বিরাটভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, আমি তার সমালোচক ছিলাম। নানাভাবে তার সমালোচনা করেছি। শেষ সমালোচনাটি চট্টগ্রামের পত্রিকায় বেরিয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছিল, তাতে অহেতুক কয়েকটি র‌্যাম্প সংযোজনের বিরোধিতা করেছি এই বলে- এত র‌্যাম্পের কোনো প্রয়োজন নেই; তা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়াবে ও কতিপয় লোকের পকেট স্ফীত করবে। আমি এই র‌্যাম্প সৃষ্টির বিরোধিতা করে আরো যে কথাটি বলেছিলাম, সেটি হলো- এই র‌্যাম্পগুলোর মধ্যে একটি সিআরবির অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন করবে।

বাংলাদেশে কতিপয় ব্যক্তি গত কয়েক বছরে যেভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছিল (এদের মধ্যে অনেক মন্ত্রীও ছিলেন), তা আমাকে প্রচণ্ড ব্যথিত করেছিল, আঘাত করেছিল। এজন্যই আমি আওয়ামী লীগের গত দ্বিবার্ষিক কনফারেন্সে যাইনি। তবুও আমার নাম আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আরো কয়েকজনের সঙ্গে, যারা আওয়ামী লীগের এই পরিষদের সভায় যেতে শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন; যেমন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হামিদা বানু। আমি এই উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা, যা ৭ জুন ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও যাইনি।

আমি সিআরবি রক্ষার জন্য চট্টগ্রামের অন্য বিদগ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে যে আন্দোলন ৪০০ দিনব্যাপী করেছিলাম, সেই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে সরকারের অভিপ্রায়বিরোধী। সেই কারণে তৎকালীন সরকারের সব মন্ত্রী, এমপি ও ঊর্ধ্বতন আমলারা আমাদের তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। এই আন্দোলনে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী ও দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদকরাও আমাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন। এটা ছিল আমাদের জন্য বড় প্রাপ্তি। দেশের অন্যান্য সংবাদপত্রও আমাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছিল। আমরা যেভাবে এই আন্দোলনের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের দ্বারা ভর্ৎসিত হয়েছি, তা বলার নয়! তারপরও আজ আমি স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে অভিহিত হচ্ছি। জীবনব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের বাকস্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার ছাত্র (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের), তৎকালীন শিবির নেতা, বর্তমানে জামায়াত নেতা শামসুল ইসলাম, যিনি এখন আইআইইউসির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন, তার এমএ ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভার সময় পাকিস্তানের করাচি থেকে কোনো একটি কনফারেন্স বা সেমিনারের আমন্ত্রণপত্র পান। তিনি আমাকে জানান, তিনি ভাইভা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে এই কনফারেন্সে যোগ দিতে পারবেন না। তার জন্য কি কোনোভাবে এই ভাইভাটি পরে নেয়া যাবে? আমি ছিলাম এই এমএ ফাইনাল পরীক্ষার চেয়ারম্যান। এই পরীক্ষায় এক্সটারনাল পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত প্রফেসর আফসার উদ্দিন। ভাইভা পরীক্ষা একবারই হয়। তবুও আমি প্রফেসর আফসার সাহেবকে অনুরোধ করি, পরবর্তী একটি দিনে এই ভাইভা নেয়া যায় কিনা। ইন্টারনাল পরীক্ষকদের আমি আগেই রাজি করিয়েছিলাম। প্রফেসর আফসার, যিনি আমারও শিক্ষক ছিলেন, তিনি আমার বিশেষ অনুরোধে পরে আসতে সম্মত হন। তিনি জানান, এই পরীক্ষা নেয়ার জন্য তিনি কোনো রেমুনারেশন নেবেন না। শুধু ঢাকা থেকে যাতায়াতের ভাড়াটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিলেই হবে। আমি পরবর্তীকালে একটি দিন ধার্য করে এই পরীক্ষা নিয়েছিলাম। শামসুল ইসলামকে করাচিতে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলাম। আফসার স্যারকে আমি নিজেই আমার পকেট থেকে তার যাতায়াতের ভাড়া দিয়েছিলাম, যা তিনি জানতে পারেননি। শামসুল ইসলামের নিশ্চয়ই এই ভাইভার কথা এখনো মনে আছে। আমি সব ছাত্রকে সব সময় ছাত্র হিসেবেই দেখেছি। মানুষকে মানুষের মতো দেখেছি। সে কোন রাজনৈতিক দল করে- তা বিবেচনায় নিইনি; ছাত্র ছাত্রই। মানুষকে ভালোবেসেছি বলে মানুষও আমাকে ভালোবেসেছে। দৈনিক কর্ণফুলীর সম্পাদক চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াত ইসলামের সাবেক আমির আফসার আমার একজন নিকটজন ছিলেন, যদিও আমাদের দুজনের ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ছিল। আমার এক বছর বয়সি মেয়ের হাত ভাঙলে তিনি নিজে কোলে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। আমাকে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তা জানিয়েছিলেন। আমার অনেক বিএনপিপন্থি প্রিয় ছাত্র-শিক্ষক ছিলেন, এখনো বেঁচে আছেন। একজন মারা গেছেন। তিনি হলেন ড. মাহবুব উল্লাহ, যিনি আমার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করেছিলেন, ইউজিসির ক্ষণকালীন চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। আজ দুঃখের বিষয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আমাকে স্বৈরাচারের দোসর বলছে। জীবনে কোনোদিন জ্ঞাতসারে কারও ওপর কর্তৃত্ব করিনি, সবার উপকার করার চেষ্টা করেছি।

যেসব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আমার পদত্যাগ চেয়েছে, তাদের আমি জানাতে চাই, আমি সারাজীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। আমি অতি সাধারণ জীবনযাপন করি। আমি কোনোদিন বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেছি, এমনটি মনে পড়ে না। ছাত্রদের যেমন সমভাবে দেখেছি, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও সম্মানজনকভাবে ব্যবহার করেছি।

যাই হোক, আমি এখন অসুস্থ। প্রায় তিন মাসব্যাপী ফ্রজেন সোল্ডারের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। ২০২১ সালের শেষে চোখেও রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এখন তা ক্যাটারক্ট আক্রান্ত। তাই আমি নিজেই অব্যাহতি চাই। তা সত্ত্বেও আমি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করে যাচ্ছি। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সহজ প্রবাহে চলে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি শুধু ছাত্রদের বেতন, অর্থাৎ সেমিস্টার ফি, ভর্তি ফি ইত্যাদি। এখানে কোনো সরকারি অনুদান নেই। আবার হঠাৎ করে সরকার থেকে নানা কর ইত্যাদি আরোপ করা হয়। গত দু-তিন মাসে আমরা এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০২২-২৩ সময়কালের জন্য নবনির্ধারিত প্রায় ২৪ কোটি টাকা ইনকম ট্যাক্স দিয়েছি। এখনো প্রায় কোটির বেশি টাকা প্রদেয় রয়েছে। এজন্য ট্রেজারার প্রফেসর ড. তৌফিক সাঈদ, রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ ইফতেখার মনির ও আমাকে যৌথভাবে কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ ও বিভিন্ন ব্যয় অতি যতœসহকারে পরিচালনা করতে হয়। প্রায় দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর অত্যন্ত মিতব্যয়ের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আজ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছি। আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে প্রায় কোনো টাকাই ছিল না। প্রায়শ ঋণ করতে হতো। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারী গলির জায়গা বা ভবন, জিইসির জায়গা বা ভবন কিছুই ছিল না। দামপাড়া ভবনের দুটি তলা নির্মিত হচ্ছিল। প্রবর্তক মোড়েও দুটি ভবন তৈরি হচ্ছিল। আজ দামপাড়া ভবন প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি থেকে স্থায়ী সনদ ও স্থায়ী ক্যাম্পাসের সনদ পেয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অনেক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে; যেমন- ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির সঙ্গে এমওইউ অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে এক বছর শিক্ষা সমাপন করে বাকি দুবছর অস্ট্রেলিয়ার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে পারবে। তার জন্য ভিসা পাবে।

প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির খ্যাতি আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যপ্ত। এটা আমার জন্য পরম তৃপ্তি। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রায় ৩০ জন জুডিশিয়ারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন এডিশনাল জজ, সহকারী জজ, সিএমপি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করছে। অন্যান্য বিভাগও বিশাল কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছে।

আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, জীবনবীমার মাধ্যমে এককালীন বড় অর্থপ্রাপ্তির ব্যবস্থা ও স্বাস্থ বীমা করেছি।

আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কোনো দুর্নীতি, অন্যায় ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে লিখেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ : শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা বিপুল পরিমাণ অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করে তহবিল তছরুপ করা হয়েছে।’ এই বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। আমি আমার বেতন ও ভাতার বাইরে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির তহবিল থেকে এক পয়সাও অনৈতিকভাবে গ্রহণ করিনি। এই ইউনিভার্সিটির দৈনন্দিন সামান্য খরচ ছাড়া অন্যসব খরচ চেক-এর মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। আমি সুদৃঢ়ভাবে বলছি, আমার বিরুদ্ধে এক পয়সার দুর্নীতি, এক পয়সা আত্মসাৎ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। স্মারকলিপিতে আরো লেখা হয়েছে, ‘বয়সসীমা লঙ্ঘন : ৭৫ বছর বয়সসীমা অতিক্রম করার পরও তিনি ৮৪ বছর বয়সে উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে।’ এই বক্তব্যও একেবারে সঠিক নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ৭৫ বছরের বেশি বছরের কেউ উপাচার্য হতে পারবে না, এমন কোনো বিধান নেই। ৭৫ বছরের বেশি বয়সি প্রফেসর সেকান্দর খান ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ছিলেন। আগেই বলেছি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্বজনপ্রীতিও নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কোনো নাতি নেই। আমার একমাত্র নাতি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে, সেই ইউনিভার্সিটির বৃত্তি নিয়ে পড়াশুনা করছে।

আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকি বা না থাকি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল কামনা করব আমার মৃত্যুদিন পর্যন্ত।

0Shares