👤 নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় ডাকাতি প্রতিরোধ অভিযানে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছুরি দিয়ে তাঁর ফুসফুস পর্যন্ত কেটে ফেলে ডাকাতেরা। গত রোববার চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে এমন তথ্য উঠে আসে।
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় ডাকাতি প্রতিরোধ অভিযানে গিয়ে ডাকাতদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন (২৩)। এঘটনায় ২৫ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আব্দুল্লাহ আল হারুনুর রশিদ বাদী হয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতিসহ হত্যা মামলা দায়ের করেন। চকরিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন বাদি হয়ে একই আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা রুজু করেন। মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পান চকরিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) অরূপ কুমার চৌধুরী।মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দীর্ঘ চার মাসের তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় এজাহারনামীয় ছয়জন আসামিকে বাদ দেন এবং নতুন করে সাতজনকে যুক্ত করে দুটি মামলায়ই মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।
আদালতে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন চকরিয়া পৌরসভার কাহারিয়াঘোনা এলাকার নুরুল কবিরের ছেলে জালাল উদ্দিন ওরফে বাবুল (৪৫), ভরামুহুরী এলাকার আকতার আহমদের ছেলে আনোয়ার হাকিম (২৮), ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব ডুমখালী এলাকার জাফর আলমের ছেলে মো. হেলাল উদ্দিন (৩৬), আব্দুল মালেকের ছেলে মো. নাছির উদ্দিন (৩৬), আবুল কালামের ছেলে মো. মোর্শেদ আলম (৩৮), ছৈয়দ আহমদের ছেলে শাহ আলম (২৭), মৃত ইব্রাহিম খলিলের ছেলে আবু হানিফ (৩৪), নুরুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ এনাম (৩৫), ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতারবিল এলাকার মৃত শহর মুল্লুকের ছেলে মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ (২৮), খাইরুজ্জামানের ছেলে মোহাম্মদ ছাদেক (৪০), ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া এলাকার মোজাফফর আহমদের ছেলে জিয়াবুল করিম (৪৮), নুরুল আলমের ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন ওরফে হোসেন (৩৩), মৃত নুরুল আলমের ছেলে এনামুল হক ওরফে তোতা এনাম (৩৫), ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ছগিরশাহ কাটা এলাকার মৃত কামাল হোসেনের ছেলে নুরুল আমিন ওরফে আমিন (৩৫), গোলাম কাদেরের ছেলে আব্দুল করিম (২৫), চিরিংগা ইউনিয়নের পূর্ব পালাকাটা এলাকার জালাল উদ্দিনের ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে বাইট্টাইয়া (৩৫), ডুলাহাজারা ইউনিয়নের রংমহল এলাকার নুর আলমের ছেলে মো. কামাল ওরফে ভিন্ডি কামাল (৩০) ও লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের অংশারঝিরি এলাকার আব্দুল জলিলের ছেলে মিনহাজ উদ্দিন (২৮)। এদের মধ্যে আব্দুল করিম, আনোয়ারুল ইসলাম, মোর্শেদ আলম, শাহ আলম, আবু হানিফ ও মিনহাজ উদ্দিন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিরা গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে আছেন।
অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়ায় মাছ ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের বাড়িতে ডাকাতি প্রস্তুতির গোপন সংবাদ পেয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে মেজর উজ্জল মিয়ার নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। এসময় ডাকাতদলের সদস্যরা যৌথবাহিনীর আভিযানিক দলকে দেখে দৌঁড়ে পালানো শুরু করে। তখন অভিযানদলের সম্মুখ সারির সদস্য লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার অগ্রসর হয়ে নিজেদের আর্মি সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বলেন এবং একটি ব্লাংক এ্যামুনেশন ফায়ার করেন। অভিযানদলের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে এসময় অস্ত্রধারী ডাকাতদের মধ্যে হেলাল উদ্দিন, নুরুল আমিন, আব্দুল করিম, মোর্শেদ আলম, নাছির উদ্দিন ও মিনহাজ উদ্দিন গুলি করতে করতে পশ্চিম দিকে দৌঁড়ে যান। এসময় লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার তাঁদের পিছনে ধাওয়া করেন। কিছু দূর গিয়ে পাশের শাহ আলমের বাড়ির উঠানের দক্ষিণ পাশে তারের বেড়ায় লেগে ডাকাত মোর্শেদ আলম পড়ে গেলে তাকে তানজিম ছারোয়ার ধরে ফেলেন। মোর্শেদ রক্ষা পাওয়ার জন্য 'নাছির, আমিন আঁরে বাচা' (নাছির, আমিন আমাকে বাঁচাও) বলে চিৎকার দিলে নুরুল আমিন তাঁর কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রটি পাশে রেখে তানজিম ছারোয়ারকে ঝাপটে ধরেন এবং নাছির উদ্দিনের কাছে থাকা ধারালো ছুরি ও মোর্শেদ আলমের কাছে থাকা টিপ ছুরি দিয়ে তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করতে থাকেন। তানজিমের গায়ে বুলেটপ্রুফ ও মাথায় হেলমেট থাকায় শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করতে না পারলেও তাঁর বাঁ বাহুতে ইউনিফর্মের শার্টসহ কেটে এবং বাঁ কাঁধের পিছনে কেটে মারাত্মক জখম হলে তানজিম ছারোয়ার ডাকাত মোর্শেদকে ছেড়ে দেন। তখন মোর্শেদ, নাছির ও নুরুল আমিন তাকে ধস্তাধস্তি করে মাটিতে ফেলে দেন। এরপর মোর্শেদ, নাছির, নুরুল আমিন ধারালো ছুরি ও টিপ ছুরি দিয়ে তানজিম ছারোয়ারকে মুখের উন্মুক্ত স্থানে তথা বাঁ চোখের উপরে (হেলমেটের অনাবৃত অংশ) এবং গলার ডান পাশে কয়েকটি আঘাত করেন। হত্যা নিশ্চিত করার জন্য গলার ডান পাশে গভীরে ছুরিটি প্রবেশ করিয়ে ফুসফুস পর্যন্ত কেটে ফেলে। একাধিক আঘাতের কয়েকটি বুলেটপ্রুফে লেগে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত টিপ ছুরির মাথা সামান্য বেঁকে যায়। তখন ঘটনাস্থলের পাশ থেকে লোকজন ও আভিযানিক দলের সদস্যদের আসতে দেখে মারাত্মক জখম অবস্থায় তানজিম ছারোয়ারকে ফেলে নুরুল আমিন, নাছির উদ্দিন ও মোর্শেদ আলম পশ্চিম দিকে বেড়া টপকে পালিয়ে যান। পাশেই থাকা ডাকাত সদস্য হেলাল উদ্দিন, মিনহাজ উদ্দিন ও আব্দুল করিম সুযোগ বুঝে উত্তর-পূর্ব দিকে দৌঁড়ে পালান। পরে মারাত্মক জখম অবস্থায় তানজিম ছারোয়ারকে উদ্ধার করে প্রথমে মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল এবং সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রামু ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।
অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ঘটনার অন্তত ৩-৪ দিন আগে থেকে আসামি জালাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ, আনোয়ার হাকিম, জিয়াবুল করিম, মো. ইসমাইল হোসেন, নুরুল আমিন, নাছির উদ্দিন, আব্দুল করিম, মোহাম্মদ সাদেক, আনোয়ারুল ইসলাম, মোরশেদ আলম, শাহ আলম, আবু হানিফ, এনামুল হক, মো. এনাম, মো. কামাল ও মিনহাজ উদ্দিন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পূর্ব মাইজপাড়ার মাছ ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ডাকাতির প্রস্তুতি নিলে হানা দেয় যৌথবাহিনী। এসময় ডাকাতদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে সেনাকর্মকর্তা তানজিম ছারোয়ার নিহত হন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চকরিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) অরূপ কুমার চৌধুরী বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, আসামিদের কললিস্ট পর্যালোচনা, গ্রেপ্তার আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও গোপন তদন্তে লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন হত্যাকাণ্ডে ১৮জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করে পলাতক ছয় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ১২ আসামি বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।