Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক’ ফয়েজ আহমদ আর নেই

‘বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক’ কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার বিনামারা এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমদ (৬৮) আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় চকরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন ( ইন্না-লিল্লাহী ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন)। মৃত্যুর সময় দুই ছেলে, স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছে।

আজ সকাল ১০টায় মগবাজার কমিউনিটি সেন্টার মাঠে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০’ লাভ করেন চকরিয়ার কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ফয়েজ আহমদ। ২০২০ সালে সারা দেশের নয়জন শিক্ষককে এই সম্মাননা জানানো হয়। প্রথম আলোতে তাঁর সম্মানে লেখায় তাকে ‘বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক’ উপাধি দেওয়া হয়।

ফয়েজ আহমদের ছেলে বোরহান উদ্দিন রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জঠিল আর কঠিন রোগে ভুগছিলেন। তবে মনের জোরে এতোদিন চলাফেরা করেছেন। কয়েকমাস ধরে একদম ঘর বন্দি হয়ে পড়েন। গতকাল আমাদের একা করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।

বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক
শিক্ষার্থীরা ভালো করুক, তা মনেপ্রাণে চাইতেন মো. ফয়েজ আহমদ। এ জন্যই শ্রেণিকক্ষের নিয়মিত পাঠদানের বাইরে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করেন বিশেষ পাঠদান। এই বিশেষ পাঠদানের কারণে বিদ্যালয়টি উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ফয়েজ আহমদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার বিনামারা এলাকায়। ১৯৭৩ সালে চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। এরপর আর্থিক দৈন্যের কারণে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত উপনিবন্ধক কার্যালয়ে নকলনবিশের কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৮০ সালে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি সহকারী শিক্ষক হিসেবে হাজিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময় চকরিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও মধ্য চকরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে যোগ দেন চকরিয়ার কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চাকরিজীবনের এই সাত বছরে এসব স্কুলে সকাল-বিকেল দুই পর্বে বিশেষ পাঠদান করে সুনাম কুড়ান মো. ফয়েজ আহমদ।

সুনাম ছড়িয়ে পড়ার পর ফয়েজ আহমদকে নিজের গ্রামের কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করে নিয়ে যান তৎকালীন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন। কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েই ফয়েজ আহমদ শুরু করেন নতুন অভিযান। চালু করেন সান্ধ্য কোর্স। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যই এই ব্যবস্থা। এত অল্প সময়ে সাফল্য পায় শিক্ষার্থীরা। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত স্কুলটি থেকে প্রতিবছরই এক থেকে চারজন পর্যন্ত বৃত্তি পেতে থাকে। বড় সাফল্য আসে ১৯৯৬ সালে। পুরো উপজেলার ১০৫টি স্কুলের মধ্যে কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঁচজন ট্যালেন্টপুলে ও পাঁচজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। ফয়েজ আহমদ গণিত বিষয়ে উপজেলার ‘মাস্টার ট্রেইনার’ ছিলেন। অতিরিক্ত পাঠদানের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো সম্মানী নিতেন না। সন্ধ্যায় যারা পড়ত, তাদের কয়েকজনের বাড়ি ছিল স্কুল থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে। রাতে পড়ানো শেষে তিনি সেসব শিক্ষার্থীকে লণ্ঠন হাতে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরতেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিশেষ পাঠদান চালু রেখেছিলেন। বয়সের কারণে পরবর্তী সময়ে আর চালিয়ে নিতে পারেননি। ২০১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অবসরে যান ফয়েজ আহমদ। দীর্ঘ ৩৬ বছরের শিক্ষকজীবনে তিনি হয়ে ওঠেন বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক।

প্রিয় শিক্ষক সম্মামনা গ্রহণ করে মো. ফয়েজ আহমদ বলেছিলেন, ‘জীবনভর চেয়েছি আমার শিক্ষার্থীরা ভালো করুক। তারা ভালো করলে জীবনের সব কষ্ট ভুলে যাই। জীবনসায়াহ্নে এসেও তাদের ভালো কিছু শুনলে খুব ভালো লাগে।’

1Shares