Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কে এই মেদভেদেভ, উদারপন্থী নেতা থেকে কীভাবে হয়ে উঠলেন উসকানিদাতা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ইতিমধ্যে দিমিত্রি মেদভেদেভ অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রুশ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে একবার তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যৌথ সদিচ্ছার ওপর বিশ্বের অনেক সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে।’

ক্রেমলিনের ‘আক্রমণাত্মক মুখপাত্র’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চলতি সপ্তাহে মেদভেদেভ দুইবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর মেদভেদেভ নিজেদের পারমাণবিক সামর্থ্য নিয়েও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

বর্তমানে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান হলেও মেদভেদেভের হাতে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তা সত্ত্বেও চলতি সপ্তাহের তাঁর কিছু উসকানিমূলক মন্তব্য বেশ আলোড়ন তুলেছে।

গত বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেওয়া এক বার্তায় মেদভেদেভ বলেন, ট্রাম্পের ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ নামে এক প্রলয়ংকরী টিভি সিরিজ কল্পনা করা উচিত। পাশাপাশি তিনি সোভিয়েত আমলের (ডেড হ্যান্ড) স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক হামলার সক্ষমতার কথাও তুলে ধরেন।

মেদভেদেভের উসকানির জবাবে ট্রাম্প শুক্রবার দুটি পারমাণবিক সাবমেরিনকে ‘উপযুক্ত অঞ্চলে’ মোতায়েনের নির্দেশ দেন।

সম্প্রতি ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পুতিনকে নতুন সময়সীমা বেঁধে দেন। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত না হলে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেন। এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ও মেদভেদেভের মধ্যে কথার লড়াই শুরু হয়।

৪২ বছর বয়সী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ এবং আজকের মেদভেদেভ অনেকটাই নতুন মানুষ। পেশায় আইনজীবী মেদভেদেভের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো গোয়েন্দা সংস্থার কাজের সঙ্গে কোনো সংযোগ ছিল না। পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির গুপ্তচর (এজেন্ট) ছিলেন।

পুতিন ও মেদভেদেভের মধ্যে অন্য বেশ কিছু পার্থক্যের মধ্যে একটি হচ্ছে এমন—দ্বিতীয়জন মানে মেদভেদেভ ইন্টারনেট ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে পুতিনের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। মেদভেদেভ রাশিয়ার অর্থনীতির আধুনিকায়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আগ্রহী ছিলেন।
মেদভেদেভ ২০১২ সালে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সেই পদে ফিরে আসেন পুতিন। আর তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী পেশাদার আমলা হিসেবে পরিচিত মেদভেদেভ চরম জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হন। তিনি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় সময় উসকানিমূলক মন্তব্য দিয়ে রাশিয়ার প্রতিপক্ষকে উপহাস করেন।

সিএনএনকে ২০০৯ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেদভেদেভ বলেছিলেন, ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার সব অর্থেই ভালো, উন্নত সম্পর্ক থাকা দরকার।’ তবে গত মে মাসে ট্রাম্পের একটি মন্তব্যের জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘ট্রাম্প বলেছেন পুতিন আগুন নিয়ে খেলছেন। আর রাশিয়ার জন্য ভয়াবহ কিছু হতে পারে। ভয়াবহ জিনিস বলতে আমি কেবল একটি জিনিসই চিনি, তা হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আশি করি, ট্রাম্প সেটা বুঝবেন।’

মেদভেদেভের অবস্থানের এই যে রূপান্তর, সেটা প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পরপরই শুরু হয়। ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টিতে নিজের গুরুত্ব ধরে রাখতেই তিনি অবস্থান বদলাতে শুরু করেন।
২০১২ সালে পার্লামেন্ট সদস্যদের উদ্দেশে মেদভেদেভ বলেছিলেন, ‘আমাকে প্রায়ই বলা হয়, আপনি তো একজন উদারপন্থী। আমি স্পষ্ট করে বলি, আমি কোনো দিনই উদারপন্থায় বিশ্বাসী ছিলাম না।’

প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মেদভেদেভ সিএনএনকে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ায় দুর্নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রী (২০১২-২০২০) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনির দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশনের তদন্তের মুখে পড়েন। সেই তদন্তে দাবি করা হয়েছিল, মেদভেদেভ রাশিয়াজুড়ে বিলাসবহুল বাড়ি, প্রমোদতরি, আঙুরবাগানসহ ‘দুর্নীতির বড় সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছেন।
মেদভেদেভের মুখপাত্র নাতালিয়া তিমাকোভা সেই তদন্তকে ‘অপপ্রচারমূলক বিস্ফোরণ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যসংবলিত ভিডিওটি ইউটিউবে অল্প সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখ বার দেখা হয়। এতে মেদভেদেভের বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাস্তায় তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়।

২০২০ সালে মেদভেদেভ হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময়টাতেই পুতিন সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করার কাজ সারছিলেন।

এর পর থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদে দায়িত্ব পালন করছেন মেদভেদেভ। এখানে নিজের পদে থেকে তিনি নিয়মিত ইউক্রেন ও পশ্চিমা নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ও অপমানজনক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। টেলিগ্রামে তাঁর বর্তমান অনুসারীর সংখ্যা ১৭ লাখ। আর এক্সের রুশ ও ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত অ্যাকাউন্ট দুটিতে তাঁর মোট অনুসারী প্রায় ৭০ লাখ।

রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর মেদভেদেভ কিয়েভের নেতৃত্বকে ‘বয়ামে জন্মানো তেলাপোকা’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন।

চলতি বছরের শুরুর দিকে এক ভাষণে মেদভেদেভ এমন একটি ছবি দেখান, যেখানে ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ব্যঙ্গাত্মক পুতুলের (ম্যাপেট) মতো সাজানো হয়েছে। পাশাপাশি কিয়েভের ‘নতুন নাৎসিদের শাসনক্ষমতা ধ্বংসের’ আহ্বান জানান তিনি।

মেদভেদেভ নিয়মিত নাৎসিবাদের আতঙ্ক তুলে ধরেন। উল্লিখিত ভাষণে তিনি বলেন, জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস ‘ক্রিমিয়া সেতুর ওপর আঘাত হানার পরামর্শ দিয়েছেন। হেই নাৎসি, এই কাজ করার আগে দুবার ভেবে দেখো!’

মেদভেদেভ পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখাতেও কোনো দ্বিধা করেন না। ২০২২ সালে তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পারমাণবিক শক্তিধর কোনো দেশকে শাস্তি দেওয়ার ধারণা অযৌক্তিক এবং তা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’

রাশিয়ার সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত আক্রমণে আনন্দ পান। গত মাসে তিনি ট্রাম্পকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুঁশিয়ারি দিয়ে উপহাস করে বলেছিলেন, ‘ঘুমন্ত জোর পথে পা বাড়িও না।’ ট্রাম্প নিজেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এই ‘ঘুমন্ত’ বিশেষণে সম্বোধন করেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, উসকানিমূলক মন্তব্য করলেও মেদভেদেভ ক্রেমলিনের বার্তাসংক্রান্ত কৌশলের অংশ হিসেবে সচেতন ভূমিকা পালন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের মতে, ‘পশ্চিমা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় সৃষ্টি করতে উসকানিমূলক বক্তব্য জোরদারের উদ্দেশ্যে’ মেদভেদেভকে ব্যবহার করা হয়। এটা ক্রেমলিনের ‘সমন্বিত তথ্যকৌশলের অংশ’। কিন্তু বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মেদভেদেভের কথাগুলো এতটা গুরুত্বসহকারে নেওয়ার কিছু নেই।
এই সপ্তাহের পাল্টাপাল্টি উসকানিমূলক মন্তব্য প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোয়ান্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের অনাতল লিভেন বলেন, মেদভেদেভের মন্তব্য ও ট্রাম্পের জবাবকে ‘স্রেফ বাগাড়ম্বর’ হিসেবে দেখা উচিত।

লিভেন বলেন, ‘রাশিয়া গত তিন বছরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞার জবাবে দেশটির এসব অস্ত্র চালানোর স্পষ্ট কোনো কারণ নেই।’

২০০৯ সালে ওবামার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেদভেদেভ ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তখন তিনি নিজেকে পুতিনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু মনে করতেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে মেদভেদেভ বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। সেগুলোর সম্পূর্ণ দায়ভারও আমাদের।’ কিন্তু ১৬ বছর পর এখন তাঁর হাতে উসকানিদাতার স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই নেই বলে মনে হচ্ছে।

0Shares