Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জলদস্যু গডফাদার ‘বদু’র আয়নাবাজি

নুরুল আবছার বদু কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের বদিউদ্দিন পাড়ার মৃত কাছিম আলী ওরফে কাশেম আলীর সন্তান। সব সরকারের ‘মধু’ খাওয়া বদু বর্তমানে রাজাখালী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি ও রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচিত সদস্য (মেম্বার)। তাঁর ভাই আরেক জলদস্যু ও ডাকাত সৈয়দ নূর রাজাখালী ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর মেয়ের জামাই আনছারুল ইসলাম টিপু রাজাখালী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। বদু নিজে আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খাঁনের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত। বদুর জলদস্যু জীবনের নাম পরিবর্তনের আয়নাবাজি নিয়ে জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫নভেম্বর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সমুদ্র সংবাদ এর পাঠকদের জন্য সংবাদটি হুবুহু তুলে ধরা হলো।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু গডফাদার নুরুল আবছার বদু। বঙ্গোপসাগরজুড়েই বিচরণ রয়েছে তার বাহিনীর। অথচ ত্রিশ বছর আগে বদি আলম নামেই অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয়েছিল আজকের দুর্ধর্ষ বদুর। বিগত সময়ে দায়ের হওয়া মামলা থেকে বাঁচতে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে বদি আলম হয়ে যান নুরুল আবছার বদু! শুধু তাই নয়, সাগরে ডাকাতি করতে তিনি ব্যবহার করেন নিজের নামে লাইসেন্স করা শটগান। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এমনসব চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য উঠে এসেছে। জলদস্যু গডফাদারের অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, ‘অস্ত্র দেওয়ার লাইসেন্স মাপকাঠি নির্ধারণ করে মূলত জেলা প্রশাসন। পুলিশ শুধু তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তের সময় অতীতের অপরাধ কর্মকান্ডের বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। তালিকাভুক্ত জলদস্যু কীভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে তা আমরা জানি না।’ মামলা থেকে রক্ষা পেতে ‘নামের আয়নাবাজি’ করার কথা অস্বীকার করেছেন নুরুল আবছার বদু। তবে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বদি উদ্দিন নামে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কথা স্বীকার করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সালে আমার নামে কিছু মামলা ছিল। পরে এ মামলাগুলো থেকে আদালত খালাস দেয়। পরেও আমার নামে কিছু মামলা হয়।’ এ সময় তিনি সাগরে জলদস্যু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের কথা অস্বীকার করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় ২০ জলদস্যু চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছেন নুরুল আবছার বদু ওরফে বদি আলম ওরফে বদু ডাকাত। তার এ বাহিনী জলেস্থলে ‘বইদ্দ্যা বাহিনী’ হিসেবে অধিক পরিচিত। বদু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জল গডফাদার। বদু বাহিনীর পরিচালনায় সেন্ডেক ইন কমান্ড হিসেবে রয়েছেন বদুর ভাই আরেক তালিকাভুক্ত জলদস্যু সৈয়দ নুর এবং মেয়ের জামাই আনসারুল ইসলাম টিপু। বইদ্দ্যা বাহিনীর সহায়ক গ্রুপ হিসেবে কাজ করে আরেক দুর্ধর্ষ জলদস্যু গ্রুপ ইসহাক বাহিনী। বঙ্গোপসাগরজুড়ে বইদ্দ্যা বাহিনীর কমপক্ষে দুই শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে। বইদ্দ্যা বাহিনী সাগরে ডাকাতির জন্য অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যবহার করে লাইসেন্স করা শটগানও। ২০০৮ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে নিজের নামে শটগানের লাইসেন্স করেন, যার নং ১৩/২০০৮। ডাকাতির জন্য ব্যবহৃত অস্ত্রের নম্বর হচ্ছে- পিসি ৬১২৫৪০। চলতি বছর তিনি এ অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করেন। বইদ্দ্যা বাহিনী নিজেদের দল ভারী করতে টার্গেট করে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া এবং বাঁশখালী এলাকার বেকার যুবক ও দাগি আসামিদের। প্রথমে তারা টার্গেটকে সাহায্যের নামে আর্থিকভাবে সহায়তা করে। পরে কৌশলে তাদের নিয়ে যায় ডাকাতিতে। কক্সবাজারের পেকুয়া থানার রাজাখালী বদি উদ্দীন পাড়ায় থাকা খামার বাড়িকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে বদু। ওই টর্চার সেলে জেলেদের আটকে রেখে করা হয় নির্যাতন। আদায় করা হয় মুক্তিপণ। অভিযোগ রয়েছে- বদু সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে নিজের অপরাধ জগত সম্প্রসারণ করেছেন। এরশাদ সরকার আমলে উত্থান হওয়া বদুর সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এ সময় তিনি সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান ও চকোরিয়া আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জাফর আলমের ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধের শাখা-প্রশাখা সম্প্রসারণ করেন।

বদি আলম থেকে নুরুল আবছার : নুরুল আবছার বদু ওরফে বদি আলমের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় ১৯৮৮ সাল থেকে দায়ের হওয়া ৩৪টি মামলার নথি আসে বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে। এ নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- তার বিরুদ্ধে দায়ের মামলাগুলোতে নাম দুটি হলেও পিতা এবং ঠিকানা অভিন্ন রয়েছে। যার মধ্যে ১৯৯৩ সালের ৩১ মার্চ বদি আলমের বিরুদ্ধে চকোরিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের হয়, যার নম্বর ৩১। একই বছর চকোরিয়া থানায় বদি আলমের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের হয়, এ মামলা নম্বর ৫, তারিখ ৫ অক্টোবর ১৯৯৩। পরে একই থানায় আরেকটি ডাকাতি মামলা দায়ের হয় বদি আলমের বিরুদ্ধে, এ মামলার নম্বর হচ্ছে ১০। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বদি আলম নামে মোট ১৫টি মামলার নথি পাওয়া যায়। ২০০০ সালের দিকে এসে বদি আলম থেকে নুরুল আবছার বদু হয়ে যান দুর্ষর্ধ জলদস্যু।

নথির তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সালে নুরুল আবছারের নামে প্রথম মামলা হয় চকরিয়া থানায়, মামলার নম্বর ১৫। ২০০৮ সালে পেকুয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলাম বাবুল নামে এক ব্যক্তি। ২০০৯ সালে পেকুয়া থানায় হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে একটি হত্যা প্রচেষ্টা মামলা দায়ের করেন আবু তাহের নামে এক ব্যক্তি। ২০১৬ সালে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয় পেকুয়া থানায়। ২০১৫ সালে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা এবং হত্যা চেষ্টার অভিযোগে পেকুয়া থানায় হয় আরেকটি মামলা। এ ছাড়া চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার থানায় অস্ত্র আইনে হয় আরেকটি মামলা।নুরুল ইসলাম বদুর নামের আয়নাবাজিকে ‘রেসনাল চয়েস থিউরি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘অপরাধ থেকে রক্ষা পেতেই অনেক ক্ষেত্রে আসামি নাম পরিবর্তন করে। আইনকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নাম পরিবর্তন করাও গুরুতর অপরাধ। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই হবে এখন রাষ্ট্রের কাজ।’

11Shares