বিয়ের দেড় বছরের মাথায় গত ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর লাভ লেন এলাকার বাসিন্দা শান্তা সূত্রধর ও সাগর দাশের ঘর আলো করে জন্ম নেয় নতুন অতিথি। তবে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই সদ্যোজাত সন্তানকে রেখে মারা যান ডেঙ্গু আক্রান্ত শান্তা। নিমেষে গোটা পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। একই দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নগরীতে মারা যান শাকিলা আক্তার নামে আরেক নারী। তাঁরও রয়েছে তিন শিশুসন্তান।
এভাবে প্রতিদিনই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যাও। কিন্তু মশকনিধন যাদের দায়িত্ব, সেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এখনও কার্যত ঘুমে বিভোর। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এখনও কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি করপোরেশনের। ঝিমিয়ে পড়েছে মশকনিধন কার্যক্রমও। বহু এলাকায় খোঁজ নেই কাউন্সিলরদের।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ গেছে ১২ জনের ও আক্রান্ত হয়েছে ৯৮৬ জন। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ১৯ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮৮ জন ও মারা গেছেন ৭ জন, যা নগরীতে এক মাসে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনেই সর্বোচ্চ ৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের দিন শনাক্ত হন ৩৪ জন রোগী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে উম্মে হানি আক্তার (২২), ১৫ সেপ্টেম্বর মেরিনা আক্তার মুক্তা (৪৬) এবং ১২ সেপ্টেম্বর ওয়াহিদুর রহমান (১৬) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। ১০ সেপ্টেম্বর এক দিনেই প্রাণ যায় আরও দুই নারীর।
জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মশার বাড়বাড়ন্তে অতিষ্ঠ মানুষ। কিন্তু মশকনিধনের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশনের কর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আত্মগোপনে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত বেশির ভাগ কাউন্সিলর। চসিকের তথ্য বলছে, মোট ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস করছেন না। বাকি ১৬ কাউন্সিলরের মধ্যে সাতজন অফিস করলেও তাও অনিয়মিত।
চসিক সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে মশার ওষুধ কেনায় তারা ব্যয় করেছেন ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। পরের বছরেও প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরেও সর্বোচ্চ আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে মশকনিধন কার্যক্রমে। এর মধ্যে শুধু ওষুধ কিনতেই চার কোটি এবং ফগার ও হ্যান্ড স্প্রে মেশিন কিনতে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই ব্যয়ের ন্যূনতম সুফল পাচ্ছেন না নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। তারা বলছেন, আগে বছরে এক মৌসুম মশার উপদ্রব থাকলেও এখন থাকছে বছরজুড়ে। বিশেষ করে বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, খতিবের হাট, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, হামজারবাগ, চকবাজার, বায়েজিদসহ কয়েকটি এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি।
সরেজমিন উল্লিখিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নালা, খাল, বাসাবাড়ির পাশের ছোট-বড় ড্রেনে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব স্থানে ভনভন করছে মশা।
ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ। চসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে গত রোববার মশকনিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি চসিক সংশ্লিষ্টদের।
তবে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর দাবি, ৪১ ওয়ার্ডেই নিয়মমাফিক মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এরপরও কয়েকটি ওয়ার্ডে মশা কমছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মশার জীবনচক্র বদলে যাচ্ছে। এ জন্য মশা নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় জানতে গবেষণা প্রয়োজন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে মশা মারার ওপর জোর দিতে হবে। কারণ, মশা না মরলে রোগীর বাড়তি চাপ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, মশা মারতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে চসিক। কাগজে-কলমে সংস্থাটি মশা মারতে কোটি টাকা খরচ করলেও বাস্তবে দৃশ্যমান নয় মশকনিধন কার্যক্রম। তাহলে বরাদ্দকৃত কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়? জবাবদিহি না থাকায় এমনটি হচ্ছে।